জগদীশ চন্দ্র বসু: আধুনিক বিজ্ঞানের পুরোধা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ২৩, ২০২১, ০৫:০১ পিএম

জগদীশ চন্দ্র বসু: আধুনিক বিজ্ঞানের পুরোধা

‘বিজ্ঞানী’ শব্দটি শুনলে অনেকেরই মনে করেন জগৎ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ। যিনি সারাক্ষণ নিজের কাজে মগ্ন থাকেন। সমাজের কোনকিছুই তাকে নাড়া দেয় না। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কয়েকজন গুণী ব্যক্তি জন্মেছেন যারা শুধু নিজের নয়, ভেবেছেন সমাজ ও সাধারণ মানুষের কথা। নিজেকে সমর্পন করেছেন মানুষের কাছে। সৃষ্টির সুফল বিলিয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে।

তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয় তারই হাত ধরে। তাঁর কারণেই এ অঞ্চলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা প্রয়াস পেয়েছে। আধুনিক চিন্তাধারার এই বিজ্ঞানীর চিন্তায় দার্শনিক পটভূমিও ছিল। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল। বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও পুরাতত্ত্ব—এগুলো নিয়েও তাঁর ব্যাপক কাজ আছে। কীভাবে এত কাজ একসঙ্গে করেছেন তিনি- এই প্রশ্ন আজও অজানা। তাই জগদীশ চন্দ্র বসুকে ‘রহস্যময়’ বিজ্ঞানীও বলা যায়।

জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহে। তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন ফরিদপুরের একটি স্কুল থেকে। এরপর ১১ বছর বয়সে তিনি কলকাতা চলে যান এবং সেখানে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৮৭৫ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন।

jog 2

বিজ্ঞানে স্নাতক করেন ১৮৭৯ সালে এবং এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান ইংল্যাণ্ডে। ইংল্যাণ্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে বি.এ. পাশ করেন। ১৮৮৪ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন।

১৮৮৫ সালে লন্ডন থেকে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হয়ে কাজ শুরু করেন জগদীশচন্দ্র বসু। বেতন পেতেন একই পদে ইংরেজদের তিন ভাগের এক ভাগ। তিন বছর তিনি এর প্রতিবাদে বেতন নেননি। চতুর্থ বছরে কর্তৃপক্ষ নিয়ম বদলাতে বাধ্য হয়। দেশে ফেরার ১০ বছর পর তিনি রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে বেতার যোগাযোগের প্রথম নমুনা প্রদর্শন করেন। আর তা ছিল মার্কনির ঘোষণার দুই বছর আগে। তিনি সূর্য থেকে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ বের হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেন। বহু পরে ১৯৪৪ সালে তা সত্যি বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

জগদীশ বসু যখন উদ্ভিদের প্রাণের প্রমাণ দেন, ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা এই বাদামি নেটিভের এত বড় দাবি সহজে মানতে চাননি। ইংল্যান্ডে সাহেবরা সরাসরি তাঁর বিরোধিতা করলেন। সেই খবর চিঠিতে পেয়ে ১৯০০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “যুদ্ধ ঘোষণা করে দিন। কাউকে রেয়াত করবেন না—যে হতভাগ্য আত্মসমর্পণ না করবে, লর্ড রবার্টসের মতো নির্মম চিত্তে তাদের পুরাতন ঘর-দুয়ার তর্কানলে জ্বালিয়ে দেবেন।”

jog 1

আজকের ওয়াইফাই টেকনোলজির আদি জনক এই বিজ্ঞানী তাঁর কোনো আবিষ্কার ব্যবসায়িক উদ্দেশে ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। আজকের যুগের ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের মতো তিনি নিজ আবিষ্কার সব মানুষের কল্যাণে উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতি ছিলেন।

জগদীশ বসুর আবিষ্কার ছিল অতি ক্ষুদ্র বেতার তরঙ্গ, যার থেকে তৈরি হয়েছে আজকের মাইক্রোওয়েভ, যা পরবর্তীতে 'সলিড স্টেট ফিজিক্স'-এর বিকাশে সাহায্য করেছিল।

আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে তাঁর আবিষ্কার নিয়ে ইংল্যাণ্ডে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ব-খ্যাত বহু বিজ্ঞানীকে চমকে দিয়েছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। লণ্ডনের একটি দৈনিক পত্রিকা ডেইলি এক্সপ্রেস তাঁকে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি দিয়েছিল। পদার্থ বিজ্ঞানে এমন অসাধারণ অবদান সত্ত্বেও জগদীশ চন্দ্র বসু সারাবিশ্বে খ্যাতিলাভ করেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে।

সরকারি বা কলেজের পরীক্ষাগারে জগদীশচন্দ্র বসু জায়গা পাননি। নিজের খরচে যন্ত্রপাতি কিনে পরীক্ষাগার বানিয়েছিলেন নিজের বাড়ির একটি ঘরে।

১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী মারা যান।

Link copied!