নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ: বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি যে অনুবাদ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৮, ২০২৩, ১১:৩৭ এএম

নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ: বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি যে অনুবাদ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজকে যে ভাষায় আমরা সাহিত্যচর্চা করি, সেটা এখনো রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে অতিক্রম করতে পারেনি। আমরা মোটামুটিভাবে তাঁর ভাষাকেই অনুসরণ করি। মোট কথা, আমাদের সাহিত্য হয় রবীন্দ্র-অনুগামী, নয়তো তাঁকে বিরোধিতা করার চেষ্টা। ফলে, রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব এই সময়েও কিছুমাত্র কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বাড়ছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মবার্ষিকী আজ সোমবার (৮ মে)। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে এবং ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক ধর্ণাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কালজয়ী এ কবি।

১৯১৩ সালে, সুইডিশ একাডেমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। পুরস্কার দেওয়া হয় কবির স্বকৃত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের জন্য। এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া তিনিই প্রথম লেখক।

১৯০১ থেকে ১৯১২ অর্থাৎ একযুগের মধ্যে যে ১৩ জনকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিলেন ইউরোপীয়। একযুগ পরে কী ভেবে এবং কোন বিচারে বাঙালি কবিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাই দিয়েছে তখনকার নোবেল কমিটি। ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরেজি সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই প্রায় অপরিচিত পীতবর্ণের বাঙালি কবিকে নোবেল পুরস্কারে না দিয়ে পারেনি।

নোবেল প্রাপ্তির আগে যা ঘটেছিল

কথা ছিল, রবীন্দ্রনাথ বিলেতে যাবেন ১৯১২ সালে, মার্চ মাসে। কিন্তু যাওয়ার আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রয়োজন হলো বিশ্রাম গ্রহণের। বিশ্রামের জন্য তিনি চলে এলেন শিলাইদহ। অসুস্থতা ও বিশ্রাম নেওয়ার সময় একটা হালকা ধরনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই শুরু করলেন নিজের কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ। বেছে নিলেন গীতাঞ্জলি। তবে কেবল এ কাব্যের মধ্যে আবদ্ধ রইলেন না তিনি। গীতাঞ্জলি থেকে গৃহীত ৫৩টি কবিতার পাশাপাশি ১৬টি কবিতা নিলেন গীতিমাল্য থেকে, ১৫টি নৈবেদ্য, ১১টি খেয়া, ৩টি শিশু থেকে, এবং কল্পনা, স্মরণ, চৈতালি, উৎসর্গ ও অচলায়তন (নাটক) থেকে নিলেন একটি করে কবিতা। সুতরাং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলির মোট ১০৪টি কবিতার অর্ধেক মাত্র—৫৩টি, গীতাঞ্জলি থেকে নেওয়া। গ্রহণ-বর্জন বিষয়ে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছু বলেননি। অনুবাদগুলো শেষ পর্যন্ত কারা পড়বে, বা পড়ার পর কীভাবে নেবে, সে বিষয়ে ওই সময়ে কতটুকুই বা জানতেন তিনি!

কয়েক মাস বিশ্রাম নেওয়ার পর যখন তিনি জাহাজে উঠলেন এবং জুন মাসের ২ তারিখ বিলেতে পৌঁছালেন, তাঁর অনুবাদকর্ম তখনো চলছিল। বিলেতে কোথায় উঠবেন, তারও স্থিরতা ছিল না। এর আগের বছর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রোদেনস্টাইনের। স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টাইন ছিলেন বিলেতের শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে রবিঠাকুরের যোগাযোগ তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিতে যে বড় ভূমিকা রেখেছিল, এতে সন্দেহ নেই। লন্ডনে পৌঁছে তাঁকেই খবর দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে করে আনা সদ্য রচিত অনুবাদগুলো তুলে দিলেন তাঁর হাতে।

এই অনুবাদকর্মের গুরুত্ব অনুধাবন করতে একটুও ভুল করেননি রোদেনস্টাইন। তিনি তৎকালীন সাহিত্যজগতের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে কবির সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন। ওই বৈঠকে আইরিশ কবি ইয়েটসের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এরপর ইয়েটসের হাতে যখন পড়ল অনুবাদগুলো, তিনি এতটাই অভিভূত হলেন যে ওই বাঙালি কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদ সংস্কার বা সংশোধনের কোনো কারণই খুঁজে পেলেন না। অথচ অনুবাদগুলো তাঁকে দেওয়া হয়েছিল সংস্কার-সংশোধনের জন্যই। সামান্য দু-একটি ভাষাঘটিত সংশোধন ছাড়া ইয়েটস কবির অনুবাদে আর কোনো কিছু করার দরকার বোধ করেননি।

কথাটার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই তাঁর অনুবাদ আসলেই কতটা তাঁর এবং এতে অন্যের হাত কতটা—এসব নিয়ে বিস্তর কথা উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য চেয়েছিলেন, এমন একজন তাঁর অনুবাদ দেখে দিন, ইংরেজি যাঁর মাতৃভাষা। নিজের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের খুব বড় ধারণা ছিল না।

গীতাঞ্জলি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ বিষয়ে ৬ মে ১৯১৩ তারিখে লন্ডন থেকে রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জ্জমার কথা লিখেছিস্। ওটা যে কেমন করে লিখ্লুম এবং কেমন করে লোকের এত ভাল লেগে গেল, সে কথা আমি আজ পর্যন্ত ভেবেই পেলুম না। আমি যে ইংরেজি লিখেত পারিনে এ কথাটা এমনি সাদা যে এ সম্বন্ধে লজ্জা করবার মত অভিমানটুকুও আমার কোনোদিন ছিল না। যদি আমাকে কেউ চা খাবার নিমন্ত্রণ করে ইংরেজিতে চিঠি লিখ্ত তাহলে তার জবাব দিতে আমার ভরসা হত না...।’

কিন্তু দেখা গেল, ইয়েটসের মতো কবি অকুণ্ঠ স্বরে রায় দিলেন, গত ১০ বছরে তিনি ইংরেজি ভাষায় এমন রচনা দেখেননি। ইয়েটস এর পর যেখানেই গেছেন, তাঁর সঙ্গে থেকেছে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের খাতা। অনুবাদগুলো পড়ে তাঁর মনের উত্তেজনার কথা নিজেই বলেছেন তিনি। এ যেন এক নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের আনন্দ ও উত্তেজনা।

সত্যি বলতে, ইংরেজি গীতাঞ্জলির একধরনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ আছে—রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর আমরা এতে শুনতে পাই। আধুনিক অনুবাদ ইংরেজি ভাষার দিক দিয়ে এবং কাব্যসৌন্দর্যের দিক দিয়ে যদি রবীন্দ্রনাথের অনুবাদকে ছাড়িয়েও যায়, তবু আমাদের বারবার করে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির কাছেই ফিরে আসতে হবে।

Link copied!