সংস্কৃতি উপদেষ্টার দাবির প্রেক্ষিতে আয়োজকদের প্রশ্ন ‘নাট্যকর্মীদের কারা উৎসব বন্ধ চাইল’

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫, ০২:৫১ পিএম

সংস্কৃতি উপদেষ্টার দাবির প্রেক্ষিতে আয়োজকদের প্রশ্ন ‘নাট্যকর্মীদের কারা উৎসব বন্ধ চাইল’

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব ‘হুমকির মুখে’ স্থগিত হওয়ার পর সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বললেন, নাট্যকর্মীদের ‘বিক্ষুব্ধ একটি অংশের’ দাবির পরিপ্রেক্ষিতিই মহিলা সমিতি থেকে উৎসবের ভেন্যু বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে।

রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, নাট্যকর্মীদের ‘বিক্ষুব্ধ’ অংশটি উৎসবের বিরোধিতা করে হল বরাদ্দ বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল বেশ কিছুদিন ধরে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তাদের পরিচয় না লিখে ‘মব’ বলে চালিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী উৎসব আয়োজকদের দিকে এমন প্রশ্নও ছুঁড়েছেন উপদেষ্টা।

অন্যদিকে উৎসব আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উপদেষ্টার কাছেই বিরোধিতাকারীদের নাম জানতে চেয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, নাট্যকর্মীদের মধ্যে কারা উৎসব বন্ধ করতে চাইল?

সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরও শনিবার ‘একদল ব্যক্তির হুমকির মুখে’ স্থগিত হয় ‘ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব’।

নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে উৎসব স্থগিতে বাধ্য হওয়ার কথা বলেন ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের আহ্বায়ক ঠান্ডু রায়হান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সংবাদ প্রকাশের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা।

তার পরদিন উপদেষ্টা ফারুকী তার ফেইসবুক পোস্টে বলেন, “নাট্য উৎসব বন্ধের খবরটা দেখে আমরা কাল সন্ধ্যা থেকেই খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করি। কারণ সরকার শিল্পকলার মাধ্যমে সারাদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছড়িয়ে দিতে উৎসাহ দিচ্ছে, গতকালও শিল্পকলায় তিনটা প্রদর্শনী হল। আজকেও প্রাচ্যনাটের শো আছে শিল্পকলায়। তাহলে এখানে কেনো পুলিশ উৎসব বন্ধ করতে বলবে?

“খোঁজ নিয়ে জানলাম, পুলিশ এইরকম কিছুই বলেনি। কালকে রাতেই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তারা কাউকে উৎসব বন্ধ করতে বলেনি। বরং তারা নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। তাহলে?”

সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলছেন, এ বিষয়ে দ্রুত অনুসন্ধান থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, “নাট্যকর্মীদের মধ্যেই একটা অংশ এই উৎসবের বিরোধিতা করে মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষের কাছে হল বরাদ্দ বাতিলের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে।

“বিক্ষুব্ধ নাট্যকর্মীদের দাবি, এই উৎসবের আড়ালে জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতা হত্যায় বিবৃতি দিয়ে উসকানি দেওয়া কিছু ব্যক্তি বা তাদের গোত্রীয় কিছু মানুষ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা দাবি জানায়, জুলাইয়ে তাদের ভূমিকার জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগে কোনো পূনর্বাসন চলবে না। অবশেষে কালকে মহিলা সমিতি বরাদ্দ বাতিল করে।”

কিন্তু আয়োজকরা বিবৃতিতে সেসব কিছু লেখেননি মন্তব্য করে ফারুকী বলেন, “এইসব কিছু না বলে কৌশলে প্রথমে পুলিশের কাঁধে দোষ চাপানোর চেষ্টা করল এবং বিবৃতির শেষে বলল- মবের কারণে উৎসব বাতিল করতে হল।

“তারা তো জানেই কারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। তাদের পরিচয় না লিখে মব বলে চালিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি একটা বিশেষ ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা? বা কেন ওই বিক্ষুব্ধ নাট্যকর্মীরা প্রতিবাদ করছে তারা জানে। কিন্তু সেটাও তারা বিবৃতিতে উল্লেখ না করা কি ওই বিশেষ ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কিনা সেটা সবাই ভেবে দেখতে পারেন।”

ফারুকী প্রশ্ন তোলেন, “জুলাইয়ে তাদের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে এখনো কি একবারও ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে তারা?”

সংস্কৃতি উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের সদস্য-সচিব কামাল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাট্যকর্মীদের মধ্যে কারা এই উৎসবের বিরোধিতা করছেন, তা তো আমাদের জানা নেই। মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষকে গিয়ে কারা আমাদেরকে হল বরাদ্দ না দিতে হুমকি দিয়েছেন, তা তো আমরা জানি না।

“সংস্কৃতি উপদেষ্টা যেহেতু অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছেন যে নাট্যকর্মীদের একটি অংশই বিরোধিতা করছে, তাহলে তিনি সেই নামগুলো সবাইকে জানাবেন বলে আশা করছি।”

কামাল আহমেদ বলেন, “পুলিশ থেকে উৎসব বন্ধ করতে না বললে মহিলা সমিতি আমাদেরকে বরাদ্দ দেওয়া মিলনায়তন কেন বাতিল করল? উপদেষ্টার উচিত মহিলা সমিতিকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া এবং আমাদেরকে যেন মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমরা উৎসবটা করতে চাই।

“এই উৎসবে ৮৫টি নাট্যদল অংশ নেবে, যার প্রথম পর্যায়ে ১৪টি নাট্যদলের নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে। যে নাটকগুলো নিয়ে এই উৎসব, এই নাটকগুলো অনেক দিন ধরেই মঞ্চে হচ্ছে। জুলাইয়ের পট-পরিবর্তনের পরও নাটকগুলো হচ্ছে, তাহলে এই নাটক নিয়ে কারা আপত্তি তুলছেন? তাদের নাম উপদেষ্টা জনসম্মুখে আনুক।”

শনিবার বিকাল ৫টায় ঢাকার নাটক সরণির মহিলা সমিতি মিলনায়তনে এই উৎসব উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। উৎসবের তিনটি পর্যায়ে একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করার কথা ছিল ৮৫টি নাট্যদলের।

আয়োজকরা বলছেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় মহিলা সমিতিতে কিছু লোক এসে উৎসব নিয়ে আপত্তি তোলে। উৎসব হলে হামলা করারও হুমকি দেয় তারা।

কামাল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাদের জানান যে, রমনা থানা থেকে ফোনে নাট্যোৎসব বন্ধ করতে বলা হয়েছে।

“আমরা উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে রমনা থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করি। সন্ধ্যায় আমরা ওসি সাহেবের সাথে তার অফিসে সাক্ষাৎ করি এবং উৎসবের বিস্তারিত তথ্য তাকে অবহিত করি।”

উৎসবের জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে কামাল আহমেদ বলেন, “মিলনায়তনে আমরা যে নাটকের প্রদর্শনী করি, তার জন্য তো পুলিশ থেকে অনুমতি নেওয়া হয় না। এখানে তো বিদেশি নাট্যদলের অংশগ্রহণও নাই।

“যে দলের নাটকের শো হবে, তারা তো নিয়মিতই নাটকের প্রদর্শনী করছে। এ ধরনের আয়োজনের জন্য পুলিশ বা সরকারের কোনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।”

থানায় আলোচনার পর পুলিশ নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিলে নিরাপত্তা সহযোগিতা চেয়ে একটি আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয় বলে জানান কামাল।

কিন্তু থানার ওই বৈঠকের খবর পেয়ে ‘উত্তেজিত কিছু লোক এসে মহিলা সমিতি প্রাঙ্গণে উৎসবের সাজসজ্জা খুলে ফেলে বলে আয়োজকদের ভাষ্য।

কারা ওই হুমকি দিয়েছে, তারা পরিচয় দিয়েছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে উৎসব উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব কামাল শনিবার বলেছিলেন, “বিগত দিনেও একটি নাট্যদলের নাটক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শো-এর মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং এর প্রতিবাদে নাট্যকর্মীরা যখন সমাবেশ করছিল; তখন নাট্যজন মামুনুর রশীদসহ উপস্থিত নাট্যকর্মীদের উপর যারা হামলা করেছিল, আজকের ঘটনা তারই পুনরাবৃত্তি বলে আমরা মনে করি।”

ঘটনার বিষয়ে জানতে মহিলা সমিতির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তারা কেউ নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মহিলা সমিতির দায়িত্বশীল একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই উৎসবকে ঘিরে মহিলা সমিতিতে হামলা হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এজন্য আমরা আয়োজকদের পরিস্থিতি জানিয়েছি। তারা উৎসব স্থগিত করেছেন।”

শনিবার রাতে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নাট্যোৎসব বন্ধ করা বা স্থগিত করার ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

নাট্যোৎসব ঘিরে যে কোনো প্রকার ‘অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ডিএমপি তৎপর রয়েছে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয় ওই বার্তায়।

Link copied!