জুলাই ৩০, ২০২২, ০৭:২০ পিএম
ফিংগার প্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে এই আধুনিক বিশ্বে প্রতিনিয়ত বহু অপরাধের কিনারা করছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয়, এই ফিংগার প্রিন্ট পদ্ধতি দিয়ে অফিস হাজিরা থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের লক-আনলকের মতো কাজও করা হচ্ছে। অথচ মান্দাতা আমলের সেই ফিংগার প্রিন্টকে এখনও কোনো আধুনিক পদ্ধতি ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। যে কারণে এখনও ফিংগার প্রিন্ট র্সবজন এবং সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃত আধুনকি একটি পদ্ধতি।
আঙ্গুলের অগ্রভাগের সকল রেখাবিন্যাসের প্রতিচ্ছবিই হচ্ছে ফিংগার প্রিন্ট বা আংগুলের ছাপ। কোন ব্যক্তিকে অদ্বিতীয়ভাবে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় ফিংগারপ্রিন্ট। প্রত্যেক মানুষের হাতের আঙুলের ইউনিট আলাদা।
এই পদ্ধতি মূলত অপরাধী শনাক্তকরনের উদ্দশ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছিল। আর এটি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা রাশিয়ার মতো এমন উন্নত বিশ্বের কেউ এটি আবিষ্কার করেননি। যদিও কোনো উদ্ভাবন বা আবিস্কারের কথা উঠলে তাদের কথাই সবার আগে মাথায় আসে। এই আঙ্গুলের ছাপের জনক হলেন একজন বাঙালি। অথচ তাঁর আবিস্কারের ওই কৃতিত্ব চুরিও হয়ে গিয়েছিল! আর ওই চুরিটি করেছিলেন যথারীতি একজন ইংরেজ কর্মকর্তা। কিন্তু সেই চুরির ঘটনা গোপন থাকেনি। ১০০ বছর পর সত্য উন্মোচন করে দিয়েছে ইতিহাস।
সেই সত্য ইতিহাসে আঙুলের ছাপের আবিষ্কারক হিসেবে সেই বাঙালির নাম জানা যায়। তিনি হলেন কাজি আজিজুল হক। অপরাধী শনাক্ত করার কাজে আঙুলের ছাপ বা ফিংগারপ্রিন্ট নিয়ে ঊনবিংশ শতকের শেষের দিক থেকে শুরু হওয়া এবং বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত চলতে থাকা গবেষণার ফিরিস্তি নিয়ে আলোকপাত করি। তাহলেই আমরা পেয়ে যাব সেই বিস্মৃত বাঙালিকে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে খুলনায় জন্মেছিলেন অমিত মেধাবী এই আজিজুল হক। অল্প বয়সে মা বাবা হারিয়েছিলেন তিনি। ১২ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন কলকাতায়। ক্লান্ত-শ্রান্ত আজিজুল হক যে বাড়ির সামনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ভাগ্যক্রমে সেই বাড়ির অভিভাবক তাঁর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁর। আজিজুল হকের জীবনের মোড় ঘুরে যায় ইতিহাসের এই বাঁকেই।
গণিত ও পরিসংখ্যানে অসম্ভব দক্ষ ছিলেন আজিজুল হক। তিনি যখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, তখন তাঁকে ফিংগারপ্রিন্ট তথা আঙুলের ছাপসংক্রান্ত একটা প্রকল্পে কাজ করার জন্য মনোনীত করা হয়। এই গবেষণার কাজই তাঁকে ইতিহাসের অমত্বের পৃষ্ঠায় স্থান করে দেয়। দায়িত্ব পেয়ে তিনি ফিংগার প্রিন্ট নিয়ে গবেষণা করে চমকপ্রদ সব তথ্য আবিষ্কার করেন। হয়ে যান ফিংগার প্রিন্টের জনক।
ব্রিটিশরাজের অধীনে তখন বাংলা। তখন বাংলার পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন স্যার অ্যাডওয়ার্ড হেনরি। তার সুপারিশে আজজিুল হককে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে তাঁকে তাঁর প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ করে দেন। সালটা ১৮৯২। কাজ শুরু করার পর দেখা গেল অপরাধীদের ফিংগার প্রিন্ট তো নেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আঙুলের ছাপ নেওয়া এসব কাগজপত্র ফাইলভুক্ত করা নিয়ে। এই সমস্যা সমাধান করতে গিয়েই নজির সৃষ্টি করেন আজিজুল হক। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যে পদ্ধতির আবিষ্কার হল তারই নাম হয়ে গেল হেনরি সিস্টেম বা হেনরি পদ্ধতি। অ্যাডওয়ার্ড হেনরি নিজের নামেই তা চালিয়ে দিলেন।
অবশ্য তাঁর কাজের পুরস্কার হিসেবে আজিজুল হককে দেওয়া হয়েছিল খান বাহাদুর উপাধি, পাঁচ হাজার টাকা এবং ছোটখাটো একটা জায়গিরও। চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন পুলিশের এসপি। ওদিকে হেনরি ওই গবেষণাটির ওপর ক্ল্যাসিফিকেশন অ্যান্ড ইউজেস অব ফিংগারপ্রিন্টস নামে যে বই লিখেন, তাতেও বেমালুম চেপে যান আজিজুল হকের নাম। এবং ব্রিটিশ সরকারও যথারীতি স্বীকৃতি দেয় ওই পদ্ধতিকে।
কিন্তু গোপন বিষয় আর গোপন থাকেনি। গোমর ফাঁস হয় আবিষ্কারের।
কারেন্ট সায়েন্স সাময়িকীর ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি সংখ্যায় জিএস সোধী ও যশজিৎ কাউর ‘দ্য ফরগটেন ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ারস অব ফিংগারপ্রিন্ট সায়েন্স’ শীর্ষক যে দীর্ঘ নিবন্ধটি লিখেন, তাতে তাঁরা হাতের ছাপ বা ফিংগার প্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাসকরণের ক্ষেত্রে খান বাহাদুর আজিজুল হকের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করে নেন। তারা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা স্যার অ্যাডওয়ার্ড হেনরির মুখোশ উন্মোচন করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁদের দুজনের লেখা ওই নিবন্ধ থেকে এও জানা যায় যে, আজিজুল হক তাঁর কাজের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই আবেদন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়।
বিশেষত অ্যাডওয়ার্ড হেনরি যত দিন কর্মসূত্রে ভারতে ছিলেন, তত দিন এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করার কোনো ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু হেনরির বিবেকের তাড়না বোধ হয় ছিল। সেই তাড়না থেকেই তিনি ১৯২৬ সালের ১০ মে ইন্ডিয়া অফিসের তখনকার সেক্রেটারি জেনারেলকে এক চিঠি মারফত জানান, ‘আমি এটা পরিষ্কার করতে চাই যে আমার মতে, শ্রেণীবিন্যাসকরণ (ফিংগারপ্রিন্ট) পদ্ধতিকে নিখুঁত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আমার কর্মচারীদের মধ্যে আজিজুল হক।
প্রশ্ন উঠতে পারে কেন ৩০ বছর পর আজিজুল হকের অবদানের স্বীকৃতি দিলেন তিনি? এত দিন কেন দেননি? জবাবে বলা হচ্ছে, প্রথমত, হকের পদোন্নতি। এবং দ্বিতীয়ত, ভারতীয় জনগণের ওপর তত দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাব খর্ব হওয়ার বিষয়টি। যদি হেনরির গোপনীয়তা আজিজুল হক বা তাঁর অন্য সহকর্মীরা ফাঁস করে দেন! সম্ভবত এই ভয় থেকেই আজিজুল হকের অবদানের কথা বেমালুম চেপে যাওয়া আর সম্ভব হয়নি।
এখন দিবালোকের মতো এটা স্পষ্ট যে, কথিত ‘হেনরি সিস্টেম’ আর হেনরির নয়। এখন আজিজুল হকের ভক্ত ও অনুসারীরা ফিংগার প্রিন্টের এই পদ্ধতিকে ‘হেনরি-হক-বোস সিস্টেম’ বলে অভিহিত করছেন। এই স্বীকৃতির ফলে এক বাঙালি পেয়েছেন তাঁর বিস্ময়কর এক আবিস্কারের স্বীকৃতি। আজিজুল হক পরে ১৯৩৫ সালে মারা যান। কিন্তু তিনি সশরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও তার আবিস্কৃত ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেমটি এখনো প্রচলিত আছে। সেই পদ্ধতিই এখন আরো আধুনিক হয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে।
সূত্র: গুগল, উইকিপিডিয়া