কানাডায় পাড়ি জমানো কালো টাকার মালিক বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই থাকেন টরন্টো এবং এর আশে-পাশের বিভিন্ন শহরে। দেশ থেকে অর্থ পাচার করে কানাডার কথিত ‘বেগমপাড়ায়’ যারা বাড়ি করেছেন, সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের কোনো তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে নেই। সংস্থার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘বেগমপাড়ার’ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা চেয়েও পাননি তারা।
২০২০ সালের নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়ার কথা জানানোর পরই ‘বেগমপাড়ার’ বিষয়টি আলোচনায় আসে।
কারও নাম উল্লেখ না করেই তিনি বলেছিলেন, অর্থ পাচারে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী থাকলেও সরকারি কর্মচারীই বেশি। এরপর হাই কোর্ট অর্থ পাচারকারীদের পরিচয় জানাতে বলেছিল। দুদক সেই তদন্তে নামলেও এখনও কিছু জানাতে পারেনি।
বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন বলেন, “এখনও তো দেননি উনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী)। লিস্ট পাওয়ার তো কোনো মেকানিজম আমাদের নেই। বেগমপাড়ায় কার কার বাড়ি আছে, ওই তালিকা পাওয়ার মেকানিজম তো আমাদের নেই।
“যিনি বলছেন যে তার কাছে তালিকা আছে, উনাদের কাছে বার বার চাওয়ার পরও তো পাচ্ছি না। আমরা কীভাবে আগাবো? আমরা পেলে অবশ্যই দেখব। আর আমরা যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।”
কী কী পেয়েছেন- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে মানি লন্ডারিংয়ের কিছু আছে। বেগমপাড়ার কোনো তালিকা নেই, আমাদেরকে দেয়নি।”
অর্থ পাচারের বিষয়েও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান দুদক চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে তদন্ত করি, যে দেশে টাকা যায়, যত উন্নত দেশ হোক না কেন, তারা কিন্তু আমাদের তথ্য দেয় না। কারণ টাকাগুলো সেখানে যাচ্ছে, তারা টাকাগুলো রাখার জন্যই সবসময় সঠিক তথ্য দিচ্ছে না।
“তারা বলে মামলা হলে তথ্য দিবে, আরে মামলা হওয়ার জন্যই তো আমার তথ্য দরকার। কোনো দেশই দিচ্ছে না, সহজভাবে দিচ্ছে না। এই প্রতিকূলতা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়।”
“অনেক সীমাবদ্ধতার জন্য জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কাছাকাছি যেতে পারছি না। তবে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব,” বলেন তিনি।
আসলে কি বেগমপাড়া বলে কিছু আছে কানাডায়?
বছর দুয়েক আগে কোনো এক ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শীতে জমে যাওয়া কানাডার টরন্টোর রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে যায় একদল বাংলাদেশি। অনেকে এসেছেন বহুদূর থেকে কয়েক ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে। তাদের প্রতিবাদ বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পালিয়ে আসা কথিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, যারা নাকি সেখানে পাচার করা বিপুল সম্পদ দিয়ে আয়েশি জীবন-যাপন করছেন।
হঠাৎ করে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদ কেবল কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে নয়, শোরগোল ফেলে বাংলাদেশেও। টরন্টোতে বাংলাদেশি 'বেগমপাড়া' নিয়ে এরপরই আলোচনা ডালপালা মেলে।
বলা হয় বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই 'বেগমপাড়া'। আসলে বেগমপাড়া বলে কানাডায় কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই। দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থপাচারকারীরা দেশটির বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি কিনেছেন। এদের বেশিরভাগই বাস করেন টরন্টো এবং এর আশে-পাশের বিভিন্ন শহরে। এই কমিউনিটিকেই বেগমপাড়া হিসেবে উল্লেখ করে থাকে প্রবাসীরা।
সাজ্জাদ আলি টরন্টোতে একজন রিয়েলটর (রিয়েল এস্টেট এজেন্ট) হিসেবে কাজ করছেন কয়েক বছর ধরে।
তার মতে, এরকম বেগমপাড়া নামে হয়তো কোন এলাকা নেই, কিন্তু এমন জায়গা বাস্তবে রয়েছে, যেখানে এধরণের বহু বাংলাদেশি গিয়ে বসতি গেড়েছেন।
"বেগমপাড়া যে শুধু কথার কথা, লোকমুখে শোনা ব্যাপার, তা নয়। আমরা দেখি এখানে বাংলাদেশিরা অনেক সংখ্যায়, এমন সব জায়গায় বাড়িঘর কিনেছেন, যেটা একটু অভিজাত এলাকা। কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে তাদের এই সম্পদ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা এখানে তেমন কিছু করেন বলে তো আমরা দেখি না। কীভাবে তারা এক বা দুই মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন!"
কানাডার সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ধারণা, কানাডায় অর্জিত সম্পদ দিয়ে তারা এসব বাড়ি কেনেননি, এই অর্থ এসেছে বাংলাদেশ থেকে।