বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন বিশ্বের ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’। সেই তকমা ভুল প্রমাণিত করেছে বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের থেকে এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় দুই বারই বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা ছিল সকরুণ। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা যাকে বলে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে ১৭ জানুয়ারি টাইম ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদনে লিখেছিল, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স যখন বাংলাদেশ ত্যাগ করে তখন প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে মাত্র ১১৭ রুপি রেখে গিয়েছিল।
আজকের যে বাংলাদেশ তার এই পরিবর্তন বেশি সাধিত হয়েছে বিগত ১৫ বছরে। আজকের এই বাংলাদেশে একজন মানুষের মাথাপিচু আয় পাকিস্তানীদের চেয়ে তো বেশিই ক্ষেত্র বিশেষে ভারতীয়দের চাইতেও বেশি।
বাংলাদেশের জিডিপির আকার পাকিস্তান বা ভারতের চেয়ে বড় নয়। বরং বাংলাদেশের জিডিপি পাকিস্তানের জিডিপির ৮৩ শতাংশ এবং ভারতের জিডিপির মাত্র ১১ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার এই দুই দেশের চেয়ে বেশি। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, আয় বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য এই দুই দেশের চেয়ে কম। এবং এসব কারণে, বাংলাদেশের মাথাপিচু জিডিপি এই দুই দেশের চেয়ে বেশি।
এসব তাত্ত্বিক হিসাবের বাইরেও বাংলাদেশের অগ্রগতি নির্দেশক আরও একাধিক জায়গা রয়েছে। যেমন, বিগত দুই দশক ধরে ভারত যেখানে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জায়গা থেকে সেবাখাত ভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিবর্তিত হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ সেবাখাতের পরিবর্তে কৃষিকে পাশে রেখে টেকসই শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে এগিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার গৃহীত শ্রমনীতির কারণে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিখাতে বিপুল কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিল্পখাতেও লাখ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বাংলাদেশ তার গার্মেন্টস শিল্পকে বিশ্বমানে উন্নীত করে নিয়ে গেছে। এখন বিশ্ববাজারে দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম। এই প্রতিদ্বন্দ্বীতার তালিকায় বাংলাদেশ ভারত এবং পাকিস্তানকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক উন্নতি বাংলাদেশকে স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন সামাজিক এবং মানব উন্নয়ন সূচকেও এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম কর্তৃক ২০২১ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য তালিকায় বিশ্বের ১৫৬ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশর অবস্থান ৬৫ এবং একই তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৪০ তম। অথচ, ২০০৬ সালে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১ এবং ভারতের ৯৮। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের শ্রমবাজারের নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে বিশালভাবে। বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমবাজারে অন্তত শতকরা ৪০ শ্রমশক্তি আসে নারীদের কাছ থেকে। যেখানে ভারতের মাত্র ২২.৩ শতাংশ নারী দেশটির শ্রমবাজারে শ্রমশক্তি বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়।
এদিকে, ২০২০ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশর অবস্থান ছিল ভারতের মাত্র কয়েক ধাপ পেছনে। কিন্তু এখানে আমলে নেওয়ার মতো বিষয় হলো, এই তালিকায় ভারতের অবস্থান যেখানে প্রায় স্থির সেখানে বাংলাদেশ এগিয়েছে তরতর করে। উদাহরণ হিসেবে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১ সালের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে ভারত যেখানে মাত্র ১ ধাপ এগিয়েছে সেখানে বাংলাদেশে এগিয়েছে ৮ ধাপ। কেবল তাই নয়, শিক্ষা ব্যবস্থা আমলে নিলে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার তফাৎটাও চোখে পড়ার মতো। এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন এই দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য, গড় আয়ু, পুষ্টিকর খাবার ইত্যাদি সূচক নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন। বাংলাদেশিদের গড় আয়ু যেখানে ৭২.৬ বছর সেখানে ভারতীয়দের গড় আয়ু ৬৯ বছর।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ (৭৬), ভারত (১০১) এবং পাকিস্তানের (৯২) মধ্যকার পার্থক্যেও এগিয়ে বাংলাদেশ। এছাড়াও যখন শিশু মৃত্যুহার, পুষ্টি নিশ্চিতকরণের বিষয় আসে তখনও বাংলাদেশ ভারতের চেয় অনেক অনেকে এগিয়ে থাকে।
অর্থনৈতিক সমতা অর্জনেও বাংলাদেশ ভালো সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে এমন মানুষের অনুপাতে বাংলাদেশিরা পিছিয়ে থাকলেও দেশটিতে এই পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। তবে সুপেয় পানি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে।
যাই হোক, বাংলাদেশের সামনে এখনও অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশে এখনো উচ্চ দারিদ্র্যহার বিদ্যমান। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক হিসাব অনুসারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ২০ শতাংশ।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে আয় বৈষম্য খুবই বেশি। যেখানে দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ মোট আয়ের মাত্র ১৭ শতাংশের মালিক। পক্ষান্তরে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের শতকরা ৪৩ ভাগ। এর একমাত্র কারণ হলো, ভয়াবহ দূর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২০ সালের দূর্নীতি নির্দেশক তালিকায় ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশর অবস্থান ১৪৬, ভারতের ৮৬ এবং পাকিস্তানের ১২৪। ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও অনেক মৌলিক বিষয়ে এই দুই দেশের চেয়ে পিছিয়ে।
চূড়ান্ত বিচারে, বাংলাদেশের এই আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, বাংলাদেশ কতো বেশি গণতান্ত্রিক রীতি ও মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাসী এবং তা এগিয়ে নিতে কতোটা আগ্রহী তার ওপর। এবং একইসঙ্গে, রানৈতিক দলগুলোর ’মেজরিটারিয়ান বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ এবং ‘টোটালিটারিয়ান বা সর্বগ্রাসী’ মনোভাব দূরীকরণের ওপর।
(ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবলম্বনে)