গত ৭ আগস্ট শুরু হওয়া দেশব্যাপী গণটিকা কার্যক্রমে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে। টিকা নিতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই তাদের জাতীয় পরিচয় পত্রের হুবহু কপি নির্দ্বিধায় তুলে দিচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাতে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজেদের গণটিকা কার্যক্রমের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দাবী করছেন। তাদের দাবী, তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ডাকে সাড়া দিয়েই এই স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে জড়িয়েছেন। এমন চিত্র দেশের গ্রাম-শহর সর্বত্র। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের একাধিক টিকাদান কেন্দ্রের চিত্রও একই।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জারিকৃত নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভ্যাকসিন গ্রহণে ইচ্ছুকদের তথ্য এক্সেল শিটের মাধ্যমে সংগ্রহ করবেন এবং ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য তিনজন ভলান্টিয়ার ও দুইজন স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে একটি টিম গঠন করবেন। তবে সরেজমিনে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জনগণের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সবাইকে একটি করে অননুমোদিত একটি সিরিয়াল নম্বর দিচ্ছেন। যদিও নেতাকর্মীদের দাবী, সুশৃঙ্খলভাবে টিকা দেয়ার জন্য এই সিরিয়াল নম্বর দেয়া হচ্ছে। তবে টিকা গ্রহীতাদের অভিযোগ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও তারা টিকা পাচ্ছেন না। এমনকি অনেকে ১০ ঘণ্টা দাঁড়িয়েও টিকা পাননি। গণটিকা কার্যক্রমের তৃতীয় দিনে পারভিন নামের এক গৃহকর্মী অভিযোগ করেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাদের ইচ্ছেমত লাইন সাজাচ্ছেন, ভাঙছেন। আমরা জাতীয় পরিচয় পত্র ও সিরিয়াল নম্বর নিয়ে গিয়েও টিকা পাচ্ছিনা। এর আগের দিন আসলেও আমি তখনো টিকা পাইনি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এম কে আলম এবং তার দলবলকে বনানী বিদ্যানিকেতন কেন্দ্রে এমন তৎপরতা চালাতে দেখা যায় গত ৯ আগস্ট। তার দাবী, তিনি সেখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে হাজির ছিলেন কিন্তু তিনি জানেন না, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করার পর সেগুলো দিয়ে কি করা হয়েছে বা হচ্ছে।
হাতিরপুলে ব্র্যাকের ভ্যাকসিন প্রদান কেন্দ্রে টিকা নিতে করতে আসা শামসুল আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, তার কাছে সিরিয়াল নম্বর থাকার পরও টানা দুইদিন এসেও টিকা পাননি। এমনকি তৃতীয় দিনেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমজনতাকে বঞ্চিত করে তাদের পরিচিতদের জন্য টিকা আটকে রাখায় তাকে আগের মতো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, টিকা গ্রহণের রেজিস্ট্রেশনে যেসব তথ্য প্রদান করা হয় তা আমাদের কাছে খুবই গোপনীয়। নির্দেশনা না থাকার পরও নেতাকর্মীরা জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি সংগ্রহ করছে কেন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, স্থানীয় প্রশাসন ঠিক করবে কারা ভলান্টিয়ার হবে আর কারা হবে না। তিনি আরও যোগ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার দলীয় নেতাকর্মীরা টিকা কেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা টিকা দান কার্যক্রম সহজ করতে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করবে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নির্দেশনা তারা অনুসরণ করবে’।
কোভিড-১৯ বিষয়ে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ও বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় পরিচয় পত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ। সকল অফিসিয়াল কাজে এর ফটোকপি জমা দেয়ার ফলে এর গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কিভাবে গণটিকা কার্যক্রমের সাথে জড়িত হচ্ছে তা আমার কাছে অস্পষ্ট’।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, ‘রাষ্ট্র এবং নাগরিকের যেকোনো তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমার সকল তথ্যসহ ভ্যাকসিনেশনের যাবতীয় তথ্যসহ সকল তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজির অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘পাসপোর্ট জালিয়াতি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বিদ্যমান একটি ঘটনা। যেকোনো প্রকার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে এই ধরণের জালিয়াতি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে’। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ৫ জন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সংগ্রহ করা জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তারা আরও বলেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষ তাদের তথ্যের মূল্যের ব্যাপারে সচেতন না হতে পারে কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা জানে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে’।