ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪, ০৯:১৮ পিএম
চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৪। বইপ্রেমী বাঙালিদের কাছে বইমেলা যেন প্রাণের এক মিলনমেলা। পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধুসমাজ অথবা লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্মিলন ঘটে এ মেলায়। বইমেলার ৩য় শনিবার স্কুল-কলেজ ড্রেস পড়ুয়া এক দল শিশু কিশোরের হৈ-হুল্লোড় করতে করতে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে প্রবেশের দৃশ্য এই মিলনমেলার কথা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। এবার এই প্রাণের মিলনমেলার প্রথমার্ধ বই বিক্রেতাদের আশা দেখাচ্ছে।
শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার ১৭তম দিন। সে হিসেবে ইতিমধ্যে মেলার অর্ধেক সমাপ্তি ঘটেছে। কাগজ সংকট ও কাগজের দ্বিগুণ মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবারও মেলা শুরুর পূর্বে নানা শঙ্কায় ছিল প্রকাশকরা। কিন্তু মেলার প্রথমার্ধে মেলা প্রাঙ্গণে পাঠকের আনাগোনা ও বই বিক্রির হার চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকায় আশাবাদী বেশিরভাগ প্রকাশনী।
প্রথমা প্রকাশনীর প্রকাশক মো. সোহেল হাসান জানান, এ বছর বইমেলায় আমাদের ৭০টি নতুন বই আসার কথা। এর মধ্যে অর্ধেক বই মেলায় আনা হয়েছে এবং বাকি বই খুব শীঘ্রই মেলায় আনা হবে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বিক্রির পরিমাণ বেশ ভালো। তাছাড়া ভালোবাসা দিবস ও বসন্তের আগমনী উপলক্ষে দর্শনার্থীরা অনেক বই কিনেছেন।
বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে মিজান পাবলিশাসের বিপণন কর্মী সুরাইয়া আক্তার দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, এবছর মেলায় তুলনামূলক বেশি বই বিক্রি হচ্ছে। মেট্রোরেল হওয়ার পর প্রচুর মানুষ মেলায় এসেছে। মানুষের ভিড়ের তুলনায় কম বিক্রি হলেও বিক্রি আশাজনক।
এদিকে কথা প্রকাশের বিক্রয় প্রতিনিধি হাসান মিয়া বলেন, গত দুই-তিন বছর কোভিডের কারণে আমাদের মনে একটা শঙ্কা ছিল। মেলায় বিক্রিও আশানুরূপ ছিল না। যেহেতু এবার আর কোভিডের আতঙ্ক নেই, তাই শুরু থেকেই পাঠকরা আসছেন, মেলা ঘুরে দেখছেন। তবে প্রথম দিকে মানুষ ঘুরে দেখেই চলে যেত, এখন বই বিক্রি হচ্ছে ভালোই। তাছাড়া সব মিলিয়ে এবারের প্রথমার্ধ হিসেবে লক্ষণ ভালো।
অক্ষর প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বিক্রির সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়ছে। এ বছর আমাদের এখানে শুধুমাত্র একটি নতুন বই এসেছে। বইটি হলো আলতাফ হোসেন উজ্জ্বলের ‘হলুদ সন্ধ্যার চাঁদ’। পরবর্তী বই মেলায় বেশি বই আসবে।
প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে এই পর্যন্ত বইমেলায় নতুন প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪৯৭টি। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর ১৭তম দিন নতুন বই এসেছে ১৭১টি।
শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা
সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ক-শাখায় ১ম হয়েছেন নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির, ২য় হয়েছেন রোদসী আদৃতা এবং ৩য় হয়েছেন নৈঋতা ভৌমিক। খ- শাখায় ১ম হয়েছেন তানজিম বিন তাজ প্রত্যয়, ২য় হয়েছেন সুরাইয়া আক্তার এবং ৩য় হয়েছেন রোদসী নূর সিদ্দিকী। গ-শাখায় ১ম হয়েছেন কে. এম, মুনিফ ফারহান দীপ্ত, ২য় হয়েছেন নবজিৎ সাহা এবং ৩য় হয়েছেন সরকার একান্ত ঐতিহ্য। বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন সংগীত-ব্যক্তিত্ব শেখ সাদী খান, মোঃ ইয়াকুব আলী খান এবং চন্দনা মজুমদার।
মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪ টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ: শহীদ সাবের এবং স্মরণ: পান্না কায়সার শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে মনির ইউসুফ এবং মামুন সিদ্দিকী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন গিয়াস উদ্দিন, রতন সিদ্দিকী এবং শমী কায়সার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রামেন্দু মজুমদার।
আধুনিকতার বেদনা ও মহিম শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে মনির ইউসুফ বলেন, শহীদ সাবের তাঁর সাহসী, বেদনাদগ্ধ, সংবেদনশীল, সরল-সুন্দর, গভীর ধ্যানমগ্ন চোখে এই ভূমিকে আত্মস্থ করেছিলেন। মানব-মহত্ত্ব ও মানুষের মুক্তির প্রশ্নে তিনি কখনও আপস করেননি। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি মানবমুক্তির পথ, মার্কসীয় দর্শন, প্রগতি ও সৌন্দর্যচেতনা আঁকড়ে ধরে ছিলেন। শিল্পের সাধনায় উৎসর্গ করেছিলেন নিজের জীবন।
পান্না কায়সার: দীপান্বিতার অবিরাম পদযাত্রা শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে মামুন সিদ্দিকী বলেন, পান্না কায়সার ছিলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম বাতিঘর। লেখক ও সংগঠক হিসেবে নিজেকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ ও উদারনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে দিয়ে পান্না কায়সার তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে রামেন্দু মজুমদার বলেন, বিপ্লবী চিন্তাচেতনার অধিকারী শহীদ সাবের মানুষের কল্যাণের জন্য এবং একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আর পান্না কায়সার ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ একজন সংগ্রামী নারী। তাঁদের আদর্শ, চিন্তাচেতনা ও কর্ম সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করতে হবে।
লেখক বলছি
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি শান্তা মারিয়া, কথাসাহিত্যিক এশরার লতিফ, শিশুসাহিত্যিক আহসান মালেক এবং প্রাবন্ধিক সুমন শামস।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মিনার মনসুর, হাফিজ রশিদ খান ও আয়শা ঝর্না। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী গোলাম সারোয়ার এবং রফিকুল ইসলাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুথি পাঠ করেন কাব্য কামরুল।
এছাড়াও ছিল আবিদা রহমান সেতুর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বহ্নিশিখা’ এবং মঙ্গল চন্দ্র মণ্ডলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী জীবন চৌধুরী, মীম বাউল, ঝর্ণা বিশ্বাস, ফারুক হোসেন, নাফিসা ইসলাম ফাইজা, অমিয় বাউল এবং তামান্না নিগার তুলি।
বই সংলাপ ও রিকশাচিত্র মঞ্চের উদ্বোধন
অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ আয়োজনের অংশ হিসেবে এদিন প্রথমবারের মতো সংযোজিত ‘বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চ’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠান বিকাল ৫টায় মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের লেকসংলগ্ন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। মঞ্চের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান, আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি, বাংলা একাডেমির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. হাসান কবীর এবং বাংলা একাডেমির পরিচালকবৃন্দ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা খালিদ মারুফ।
রবিবার( ১৮ই ফেব্রুয়ারি) থেকে এই মঞ্চে প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে রিকশাচিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি মেলায় প্রকাশিত মানসম্পন্ন নির্বাচিত বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান চলবে। অনুষ্ঠানে প্রকাশকগণ বইমেলার বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত আলোচনায় অংশ নেবেন। এছাড়া বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বই বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
রবিবারের সময়সূচি
রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে বইমেলার ১৮তম দিন মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ: জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন স্বরোচিষ সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং এম আবদুল আলীম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কামাল চৌধুরী।