চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪। বইপ্রেমী বাঙালিদের কাছে বইমেলা যেন প্রাণের এক মিলনমেলা। পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধুসমাজ অথবা লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্মিলন ঘটে এ মেলায়। প্রতিদিনই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে পাঠকরা ছুটে আসছেন মেলায়। আর যারা পড়াশোনা করে দৃষ্টিকে জয় করেছেন সে সব দৃষ্টিহীন মানুষদের নতুন বই পড়ার আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য মেলায় নেই তেমন কোনো আয়োজন।
এবারের বইমেলায় মোট ৬৩৫টি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পাঠকদের জন্য রয়েছে একটি মাত্র স্টল। বাংলা একাডেমির বইমেলার প্রাঙ্গণে রয়েছে ‘স্পর্শ’র স্টল। কিন্তু দৃষ্টিহীন পাঠকদের দাবি প্রতি স্টলে অন্তত একটি ব্রেইল বই থাকা উচিত।
যাদের দৃষ্টি নেই, তাদের বই পড়ার পরিসরকে আরও বিস্তৃত ও সহজ করার পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৮ সালে যাত্রা করে স্পর্শ ফাউন্ডেশন। ২০০৯ সালে তারা প্রথম একটি ছড়ার বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশ করে।
এবারের বইমেলায় স্পর্শের স্টলে দেখা যায়, বইয়ের পাতা খুলে হাতের স্পর্শে পড়ছেন একদল শিক্ষার্থী। এ সময় তাদের জন্য অন্য কোনো স্টলে বই না থাকায় আক্ষেপ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের কাছে প্রকাশ করেন তারা বলেন, আমাদের জন্য প্রতিটি স্টলে অন্তত একটি ব্রেইল বই থাকা উচিত।
স্পর্শের স্টলের তত্ত্বাবধায়ক নন্দিতা সাহা জানান, ২০১২ সাল থেকে বইমেলায় নিয়মিত স্টল দিচ্ছেন তারা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ব্রেইল বই এসেছে ১১৯টি। তবে এ বছরই আসবে আরো ১৯টি বই।
নন্দিতা আরও জানান, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা অনেক ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন। কিন্তু নানা জটিলতায় ব্রেইল আকারে সেসব বই প্রকাশ করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কপিরাইটের কারণে অনেক প্রকাশনা অনুমতি দেয় না। যে কারণে অনেক ভালো ভালো বই পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
স্পৰ্শ’র আরেক স্বেচ্ছাসেবক ঊষা বলেন, ‘দৃষ্টিহীনদের মাঝে সাহিত্যের রস পৌঁছানোই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বইমেলায় শুধু আমাদের এই প্রকাশনীতেই দৃষ্টিহীনদের ব্রেইল বই পাওয়া যায়। আমরা চাই, যারা দৃষ্টিহীন তারাও যেন সাহিত্যের রস থেকে বঞ্চিত না হয়।
‘তাদেরও তো ইচ্ছে থাকে যে তারা বিভিন্ন লেখকের গল্প-উপন্যাসের বই পড়বে। তারা জাফর ইকবাল স্যার, হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে পড়তে চায়। কিন্তু এসব বই তো আর ব্রেইলে পাওয়া যায় না। বইমেলার প্রতিটি স্টলে যেন ব্রেইল বই থাকে সেটাই আমাদের সামাজিক আন্দোলনের লক্ষ্য।’
ঊষা বলেন, ‘আমরা এখানে কোনো ব্রেইল বই বিক্রি করি না। এখানে দৃষ্টিহীনরা আসে আর বসে বই পড়ে। আর আমাদের যখন প্রকাশনা উৎসব হয় তখন যেসব দৃষ্টিজয়ী রেজিস্ট্রেশন করেছে তাদের মাঝে ব্রেইল বই ফ্রিতে বিতরণ করা হয়।
‘গত বছর পর্যন্ত আমাদের মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ১০১টি। আর এ বছর সুলতানাস ড্রিম, চাঁদের পাহাড়, বাবা যখন ছোট, আমার দেশের মাটির গন্ধে, একাত্তরের চিঠিসহ মোট ত্রিশটি বই আমরা প্রকাশ করছি। ২৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রকাশনা উৎসবে এসব বই ফ্রিতে বিতরণ করা হবে।’
ব্রেইল বই লেখা আর পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে ঊষা বলেন, ‘ব্রেইল বই পড়ার জন্য ছয় ডটের একটি কোড নম্বর থাকে। বাংলার প্রতিটি বর্ণ এই ছয় ডট দিয়ে লেখা। ব্রেইল বই পড়তে হলে তাদের এই ছয় ডটের কোড শিখতে হয়। এরপর তারা পৃষ্ঠাকয় থাকা ছাপ হাত দিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারে কোন বর্ণ দিয়ে কী শব্দ লেখা হয়েছে।’
ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুলের দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থী আফিফা মেলায় এসেছেন মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে আমি শুধু পাঠ্যবই পড়তাম। গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়তে পারতাম না। স্পর্শ বইমেলায় আমাদের জন্য বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। না হয় আমরা বইমেলার আনন্দটা থেকে বঞ্চিত হতাম। আমি প্রতিদিন মেলায় আসি, নতুন নতুন বই পড়ি। আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। বইমেলায় অংশ নেয়া প্রতিটি প্রকাশনায় যেন আমাদের জন্য প্রতিবছর একটি করে হলেও ব্রেইল বই রাখে সে প্রত্যাশা করছি।’
আফিফার মা তানহা আক্তার লিপি বলেন, ‘আমার দুইটা মেয়েই দৃষ্টিজয়ী। সবাই বইমেলায় এসে বই পড়তে পারলেও তারা পড়তে পারতো না। পরে জানলাম যে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা এই সুযোগটা রেখেছে। এখন মেয়েদের আমি মেলায় নিয়ে আসি, তারা বই পড়ে। এটি দেখতেও আমার ভালো লাগে। স্পর্শকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করেন তিনি।
নতুন বইয়ের গল্প
রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার ১৮তম দিনে নতুন বই এসেছে ৮৩টি। রবিবার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে স্মরণ : জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বরোচিষ সরকার। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং এম আবদুল আলীম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কবি কামাল চৌধুরী।
‘আজ লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, শিশুসাহিত্যিক রোমেন রায়হান, কবি সৈকত হাবিব এবং গীতিকবি মনোরঞ্জন বালা।
আগামীকাল যা থাকছে বইমেলায়
আগামীকাল সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে বইমেলার ১৯তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ : হাসান আজিজুল হক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মোজাফ্ফর হোসেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ফারুক মঈনউদ্দীন এবং মহীবুল আজিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।