ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে রাজধানীর লালমাটিয়া ও ধানমন্ডির বাসা থেকে এলএসডি নামক মাদক জব্দ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ। দেশে এলএসডি জব্দের ঘটনা এটাই প্রথম বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
নেদারল্যান্ড থেকে চিঠিতে আসত এলএসডি
নেদারল্যান্ড থেকে এলএসডি মাদক মেইল বা চিঠির মাধ্যমে আসত এলএসডি। কাগজের মত দেখায় সাধারণত কেউ এই বিষয়টি নিয়ে তদারকি করেনি। অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেন (পেমেন্ট) ব্যবস্থা পেপ্যালের মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়। দেশে প্রতি ডোজ মাত্র তিনহাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। ফেসবুকে ‘আপনার আব্বা’ নামের আইডি ও বেটার বাউরি এন্ড বিয়ন্ড নামে একটি গ্রুপের মাধ্যমে ওই মাদকের ক্রেতা সংগ্রহ করা হয়। গ্রুপে সদস্যসংখ্যা এক হাজারের বেশি। নেদারল্যান্ড থেকে প্রতি ব্লট বা ডোজ ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়।
প্রথমবারের মত আটক কাগজের এলএসডি।
৬ লাখ টাকার ২০০ টি ব্লট উদ্ধার
এই উদ্ধার অভিযানে এখন পর্যন্ত ২০০ টি এলএসডির ব্লট উদ্ধার করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬ লাখ টাকা। কাগজে মাদক মিশ্রণ করে এই ব্লুট তৈরি করা হয়। যা জিহ্বার নিচে দিয়ে নেশা করতে হয়। নানাভাবে এলএসডি বাজারজাত করা হয়। যেমন: ব্লট পেপার বা নকশা করা বিশেষ কাগজে এলএসডি মেশানো হয়। এভাবেই এলএসডি বেশি সহজলভ্য। এ ছাড়া ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে, তরল বা কিউব আকারে পাওয়া যায়।
প্রতিটি কাগজের ব্লুট ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করা হত।
তিনজনকে গ্রেফতার
এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গতবুধবার (২৬ মে) রাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তাঁরা হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব রুপল (২৫) ও আসহাব ওয়াদুদ তুর্জ (২২) এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফ (২৩) । রুপল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর ছাত্র ছিলেন। ড্রপ আউট হওয়ার পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ডিবিতে।
এলএসডি সেবন করেছিল হাফিজ?
ডিবি সূত্র বলছে, ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তাঁর তিন বন্ধু এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তাঁর মৃত্যু হয়। এর আট দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তাঁর লাশ শনাক্ত করেন।
গোয়েন্দা পুলিশে হাফিজের তিন বন্ধু
নিখোঁজের আগে কার্জন হলে হাফিজুর রহমানের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ সেশনের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ মোহাম্মদ বাপ্পী ও ঢাকা কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী খন্দকার রাফসানসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। আসিফ বাপ্পী ও রাফসানকে জিজ্ঞাসাবাদ সোমবার (২৫ মে) রাত ১০ টায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাদের রাত ২ টায় ছেড়ে দেয়া হয়। তবে আজ এদের আবারও তলব করে গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। সেই সাথে নূর উদ্দিন আল মাসুদ নামে একজনকেও গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে পাঠান হয়।
হাফিজের তিন বন্ধু এখন ডিবি হেফাজতে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান হয়।
এলএসডি কি
যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন ফার্মাসিউটিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া ড্রাগস ডটকমের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, লাইসারজিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয় এলএসডি। এই অ্যাসিড বিভিন্ন দানাদার শস্যে থাকা এরগোট ছত্রাকে পাওয়া যায়। ১৯৩৮ সালে বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণে প্রথম এলএসডি তৈরি হয়। এটি এতই শক্তিশালী যে এর ডোজগুলো সাধারণত মাইক্রোগ্রাম হিসেবে নেওয়া হয়। এটি উত্তেজক, আনন্দদায়ক। মনের ওপরও এর প্রভাব রয়েছে। কখনো কখনো এর প্রভাবে ভীতিকর অনুভূতি তৈরি হয়। এমনটা ঘটলে একে 'ব্যাড ট্রিপ' বলা হয়।
সহজেই গ্রহণ করা যায় এলএসডি
এলএসডি মাদক ট্যাবলেট বা প্যালেট এমনি তরল অবস্থায়ও গ্রহণ করা হয়। তবে বিশ্বে কাগজের প্যাডে ছোট আকারে এলএসডি গ্রহণই সবচেয়ে জনপ্রিয় পন্থা। বিভিন্ন রঙিন কাগজে গ্রহণ করা এই মাদকটি ২০ ঘন্টা বা তারচেয়ে বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
রঙিন পেপারের মাধ্যমে এলএসডি গ্রহণ সবচেয়ে জনপ্রিয়।
মস্তিষ্কের বিকৃতি
এলএসডি সরাসরি মস্তিষ্কে আঘাত হানে। এলএসডির দুরকম ইফেক্ট দেখা দেয় মস্তিষ্কে। পজিটিভ ইফেক্ট ও নেগেটিভ ইফেক্ট। এলএসডি প্রাথমিকভাবে সুখস্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয় ভাবা হলেও এলএসডি গ্রহনের পর অনেকের কাছে দুঃসহ স্মৃতিও ফিরে আসে। নেগেটিভ ইফেক্টের কারণে, মানুষ তাৎক্ষণিক ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে, এমনকি আত্মহত্যাও করতে পারে। এলএসডির ডোজ বারবার নেওয়া হলে দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটতে পারে ।
দেশে এলএসডির অস্তিত্ব
দেশে এলএসডির অস্তিত্ব বরাবরই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা অস্বীকার করে আসছিল। কিন্তু বিবিসির ২০১৮ সালে করা এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিদেশ থেকে এই মাদক স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশে আনা হয়। প্রতি ডোজের জন্য ২১ হাজার টাকা খরচ করতে হয় তৎকালীন সময়ে। কাগজের আদলে থাকে বিধায় এটি খুব সহজেই বহন ও বিতরণ করা যায়। এই মাদক পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে এখন সহজলভ্য ব্যবহার হয়।
বিবিসি বাংলাকে ২০১৮ সালে এলএসডির অস্তিত্বের কথা জানায় দ্বীপেন (ছদ্মনাম)।