একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার আব্দুল মান্নান হাওলাদারসহ চারজনের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার চারটি অভিযোগের বিচার শেষে এ রায় এল।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) বিচারপতি শাহীনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান, সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন। আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম।
দণ্ডিত আসামিরা হলেন– আব্দুল মান্নান হাওলাদার ওরফে আব্দুল মান্নান ডিলার ওরফে মান্নান, আশ্রাব আলী ওরফে আশরাফ আলী হাওলাদার, মহারাজ হাওলাদার ওরফে হাতকাটা মহারাজ এবং নুরুল আমীন হাওলাদার।
তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর নুরুল আমীন হাওলাদার পলাতক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় নির্যাতন, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার চারটি অভিযোগ আনা হয়েছিল আসামিদের বিরুদ্ধে। সবগুলো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চার আসামির সবার সর্বোচ্চ সাজার আদেশ এসেছে রায়ে।
প্রসিকিউটররা জানান, ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছিল ট্রাইব্যুনাল। পরে বিভিন্ন সময়ে একজন কারাগারে এবং দুজন পলাতক অবস্থায় মারা যান। জীবিত চারজনের বিষয়ে রায় ঘোষণা করল ট্রাইব্যুনাল।
মামলার নথিতে বলা হয়েছে, এই চার আসামির মধ্যে মান্নান একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগের সদস্য। আর আশরাফ আলী ও মহারাজ হাওলাদার ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভাণ্ডারিয়া পাকিস্তানের সমর্থনে থানা শান্তি কমিটিতে যোগ দেন মান্নান। পরে তিনি যোগ দেন স্থানীয় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। তার মতো আশরাফ, মহারাজা ও নুরুল আমীনও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হন।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সেসব অপরাধের অভিযোগে মামলা হলে ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা, সেখানে ৩৩ জনকে সাক্ষী করা হয়।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শেষে বৃহস্পতিবার চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিল আদালত।
চার অভিযোগ
১. একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানার ৩ নম্বর ধাওয়া ইউনিয়নের পূর্ব পশারিবুনিয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মুকুন্দু বিহারি মল্লিক, চিত্তরঞ্জন ব্যাপারী, সতিশ চন্দ্র ব্যাপারী, শরৎচন্দ্র মাঝি, রসিক ঘরামী, উপেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি ও অনন্ত চাষিকে আটক করে নিয়ে যায় এবং পরে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। আনুমানিক ৪০-৪৫টি বাড়ির মালামাল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা।
২. রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১৬ অগাস্ট ভাণ্ডারিয়ার চরখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে অমূল্য রতন হাওলাদারকে আটক করে তার ওপর নির্যাতন চালায় এবং তার বাড়িতে লুটপাট চালায়। এরপর সুরেন হাওলাদারের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে আসামিরা।
৩. পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চরখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও তার বড় ভাই চন্দ্রকান্ত মিস্ত্রিকে আটক করে নির্যাতন চালায়। পরে ২০০ টাকার বিনিময়ে তাদের হত্যার বদলে মুক্তি দেওয়া হয়।
৪. রাজাকার সদস্যরা ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর ভাণ্ডারিয়ার শিয়ালকাঠি ইউনিয়নের হিন্দু প্রধান তিনটি গ্রামে ধারাবাহিকভাবে হামলা চালায়। তারা সতিশ শিকদার, সত্যরঞ্জন হালদারসহ ১৭ জনকে আটক করে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। ২০-২৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এ সময়। পরে শিব চরণ মিস্ত্রির বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে তারা আগুন দেয়। সেখানে শিব চরণের স্ত্রী গুনমনি মিস্ত্রিকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। আসামিদের গুলিতে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়, তাদের দুইজন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।