দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ: ১৯ সিদ্ধান্ত ঐকমত্য ৮টিতে, ভিন্নমত ১১টিতে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ১, ২০২৫, ০৬:০৬ পিএম

দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ: ১৯ সিদ্ধান্ত ঐকমত্য ৮টিতে, ভিন্নমত ১১টিতে

ছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপে ২৩ দিনের সংলাপে ১৯টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ১১টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তির নোট) দেওয়ার কথা জানিয়েছে বিএনপিসহ একাধিক দল।

গত ২ জুন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৩ জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শুরু হয়। ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিনের আলোচনা কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৯টি বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হয়, যার মধ্যে আটটি বিষয়ে সবগুলো দলের মধ্যে ঐকমত্য হয়।

সংলাপে ঐকমত্য হওয়া আটটি বিষয় হলোসংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান; জরুরি অবস্থা ঘোষণা; সংবিধান সংশোধন; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; পুলিশ কমিশন গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব। সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও বাকি চারটির বিষয়ে ভিন্নমত আছে।

বাকি ১১টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে দলগুলোর, যার মধ্যে বিএনপি ও তার সমমনারা আটটিতে, সিপিবি-বাসদের একাধিকে, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন একটি করে বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেবে বলে জানিয়েছে। এ ছাড়া নোট অব ডিসেন্ট আছে বাংলাদেশ জাসদ ও বাসদ-মার্কসবাদী দলেরও।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার

সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দলের মধ্যে ২১টি দল একমত হওয়ায় কমিশন সিদ্ধান্ত জানায়, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নে ব্যর্থ হলে র‍্যাংকড চয়েসে ভোট হবে। ভোটে কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্ত হবেন দুই বিচারপতি। এ সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপিসহ পাঁচটি দল। তারা বলেছে, কমিটি প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করতে না পারলে কী হবেএ সিদ্ধান্ত হবে আগামী সংসদে।

সংসদের উচ্চকক্ষ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের শেষ দিনের সংলাপে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই উচ্চকক্ষে ১০০টি আসন থাকবে। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ পাঁচটি দল আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানিয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, বেশির ভাগ দলের মতামতের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে সিপিবি, বাসদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও আমজনতার দল উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিত করেছে।

সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের ভূমিকা

কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন লাগবে। তবে এই সিদ্ধান্তকেও দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। উচ্চকক্ষের অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দিতে চায় না দলটি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কেবল জনগণের সরাসরি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হাতেই থাকা উচিত। পরোক্ষভাবে নির্বাচিত উচ্চকক্ষকে এই ক্ষমতা দেওয়া গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।

এর জবাবে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, গণঅধিকার সভাপতি নুরুল হক নুর এবং এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ফ্যাসিবাদ রুখতে সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের সমর্থন অপরিহার্য। তাদের মতে, উচ্চকক্ষের সদস্যরা দলের মনোনয়নে এলেও তারা সমভাবে নির্বাচিত।

উচ্চকক্ষের ক্ষমতা নিয়ে সংলাপের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়। বিএনপির সমমনা জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা এবং এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনের মধ্যে এই বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

প্রধান বিচারপতি মনোনয়ন

বিএনপি ও তার সমমনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ ও ১২ ধারার এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়ানোর দুটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেবে।

কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ এবং উপজেলা পর্যায়ে অধ্বস্তন আদালত স্থাপনের কথা। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি তারা সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করতে চায়। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি করার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি নির্বাচনে বিজয়ী দলের ইশতেহার অনুযায়ী আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতি হতে পরবর্তী প্রধান বিচারপতির করার সুযোগ থাকবে। বিষয়টিতে একমত বিএনপি ও তার সমমনারা।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি

সংলাপে এমপিদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি সব দল একমত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতেও সব দল একমত, তবে কতটুকু ক্ষমতা বাড়বে, তা নিয়ে বিভিন্ন দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার পরামর্শ ছাড়া মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়ার বিষয়ে বিএনপি রাজি হয়েছে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সেনা ও বিমানবাহিনীর প্রধানসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দিতে বিএনপিসহ কয়েকটি দল রাজি হয়নি। জামায়াতও এই বিষয়ে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছে।

জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি

সংলাপে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্তত ২১টি দল ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর আইনি ভিত্তি থাকার দাবি জানিয়েছে। তারা বলেছে, আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদে সই করবে না এবং আইনি ভিত্তি না দিলে সরকার ও কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপি এই দাবির বিরোধিতা করে বলেছে, সব রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর এবং দুই বছরের মধ্যে সুপারিশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকায় এই সনদের মর্যাদা আইনের ঊর্ধ্বে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের দলিল।

নারী সংসদ সদস্য

সরাসরি নারী আসন ১০০ পরিবর্তে বিদ্যমান জাতীয় সংসদের ৫০ সংরক্ষিত নারী বহাল রেখে আগামী নির্বাচনে দলগুলোকে ৫ শতাংশ আসনে নারীদের প্রার্থী করার অনুরোধ করে কমিশন। এ বিষয়ে বিএনপি একমত। বিষয়টি নোট অব ডিসেন্ট দেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাদের দাবি সরাসরি নির্বাচনের ১৫ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়নে দলগুলোকে বাধ্য করতে। নারী আসন নিয়ে বাংলাদেশ জাসদের নোট অব ডিসেন্ট আছে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

পিএসসি ও দুদক: ২২টি দলের ঐকমত্যে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বিএনপি এতে আপত্তি জানিয়েছে।

বিএনপি ও তার সমমনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮,৯, ১১ এবং ১২ ধারার এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়ানোর দুটো বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেবে।

সংবিধানের মূলনীতি: সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার’ যুক্ত করতে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল একমত হয়েছে। তবে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।

সংলাপ বর্জন: বাহাত্তরের চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ এবং বাসদ (মার্কসবাদী) সংলাপ বর্জন করে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ জানান, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রস্তুত করে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হবে।

Link copied!