সচিবালয়ের আগুন দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা?

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪, ০৭:৪৯ পিএম

সচিবালয়ের আগুন দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা?

এবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেলো বেসামরিক প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র পরিচিত বাংলাদেশ সচিবালয়। আগুনের লেলিহান শিখায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়। কয়েকঘণ্টার প্রাণান্তকর চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কর্তব্যরত অবস্থায় ট্রাক চাপায় প্রাণ হারিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী সোহানুজ্জামান নয়ন।

দেশের আলোচিত এ ঘটনার পর স্বাভাবিকবেই প্রশ্ন আসছে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে থাকা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে কীভাবে লাগলো, এই আগুন? এটা কি নাশকতা, নাকি নিছকই দুর্ঘটনা। আগুন নেভাতেই বা এতো সময় লাগলো কেনো?

অবশ্য ঘটনার পরপরই আগুন লাগার কারণ খুঁজতে অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত গঠিত গঠন করা হয়েছে।

এই কমিটি আগুনের উৎস ও কারণ খুঁজবে এবং এর পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায় আছে কিনা তা উদঘাটন করবে। পাশাপাশি এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশও প্রণয়ন করবে।

বুধবার গভীর রাতে হঠাৎ করেই আগুন দেখা যায় সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে। একটি ফ্লোর এমাথা-ওমাথা পর্যন্ত আগুন ছড়িয়ে পরে। এরপর অন্যান্য ফ্লোরেও আগুনের বিস্তার ঘটে।

খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একে একে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ফায়ার আরো কয়েকটি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৯টি ইউনিট মিলে দশ ঘণ্টার চেষ্টায় চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

১০ তলা বিশিষ্ট যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে, সেই ভবনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো-

>> অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ;

>> স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ;

>> সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ;

>> শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়;

>> ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ;ৎ

>> এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়;

এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মূলত ছয়, সাত ও আটতলায় ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।

আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অফিসের নথিপত্র, কম্পিউটার, আসবাব। আর আগুন নেভানোর সময় ছিটানো পানিতেও নষ্ট হয়ে গেছে বহু ফাইল ও নথিপত্র।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের এতোগুলো ইউনিট পৌঁছানোর পরও আগুন নেভাতে ১০ ঘণ্টা লাগলো কেনো?

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন নেভাতে গিয়ে তাঁদের পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। সচিবালয়ের ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢোকাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

তাদের মতে, আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের দুটি টার্নটেবল লেডার (টিটিএল) ভেতরে ঢুকতে পেরেছে। যদি আরও বেশি টিটিএল ঢুকতে পারত, তাহলে আরও আগে আগুন নেভানো সম্ভব হতো।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আরও বলছেন, অভিযান পরিচালনা করতে তাদের বেশ সমস্যা হয়েছে। যে কারণে আগুন নেভাতে সময় লেগেছে।

কেন এই আগুন?

আগুন লাগার কারণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরগরম আলোচনা চলছে। বিভিন্নজন সন্দেহ প্রকাশ করে পোস্ট দিচ্ছেন। এমনকি সরকারের একজন উপদেষ্টা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।  

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ডিনজের ফেইসবুকে লিখেছেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল।

তিনি বলেন, আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।

আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়া নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার আমিনুল ইসলাম বলেন, তার কাছে এটা নাশকতা বলে মনে হয়েছে।

তিনি বলেন, এই আগুন শর্ট সার্কিট থেকে নয়। মনে হলো, পরিকল্পিতভাবে লাগছে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে হয়েছে। শর্ট সার্কিট হলে একটা জায়গা থেকে হয়। এক জায়গা থেকে নয়, এটা হয়েছে কয়েকটা জায়গা থেকে।

তবে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল। তিনি বলেন, যেভাবে আগুন ছড়িয়েছে, সেটা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কারণে হতে পারে। এক জায়গা আগুন ধরলে, বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে সব জায়গা ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এরকম ঘটতে পারে। তবে তদন্ত শেষ না করে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছেন।

অবশ্য আগুন লাগার জন্য সচিবালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা শেখ হাসিনার দালালদের দায়ী করেছেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।

আরও পড়ুন: ওয়াশিংটনে জয়শংকর: বাংলাদেশ নিয়েও আলোচনা হবে

নিজের ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের যারা চাটার দল ছিলো তাদের মধ্যে অন্যতম স্টেকহোল্ডার ছিল আমলাদের বৃহৎ একটা অংশ। এদের উপর ভর দিয়েই হাসিনা এই দেশে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলো।

তিনি লেখেন, যখনই বিপ্লবীরা হাসিনার অপকর্ম, চুরি, লুটপাট, দুর্নীতির দিকে নজর দিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে, তখনই সচিবালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দালালেরা বিভিন্ন অপকর্মের ফাইলগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দিলো।

Link copied!