নভেম্বর ১২, ২০২৪, ০৯:১০ পিএম
বিপ্লবীরা আবার প্রোফাইল পিকচার লাল করছেন। ঘটনাটিকে অপ্রত্যাশিতই বলা যায়। বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে তিন মাস আগেই। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তাহলে জুলাই বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠা, লাল প্রোফাইল পিকচার আবার ফিরে আসছে কেনো? এ প্রশ্নই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সবার মনে।
সোমবার অনেকটা আকস্মিকভাবেই ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার লাল করে ফেলেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর পিনাকী ভট্টাচার্য। জনপ্রিয় এই ইউটিউবার নিজেকে জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার বলে মনে করেন। প্রোফাইল পিকচার লাল করে তিনি লেখেন, বদলে ফেলুন আপনার প্রো পিক।’ এরপর আরেক পোস্টে তিনি বলেন, জুলাই শেষ হয় নাই। আসেন আমরা আমাদের প্রোফাইল ফটো আবারো লাল করে রাখি।
ওইদিনই প্রোফাইল পিকচার আবার লাল করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। প্রোফাইল পিক লাল করার পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘সাঈদ ওয়াসিম মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ/ ১৩৪ শে জুলাই, ২০২৪’।
মঙ্গলবার প্রোফাইল পিকচার লাল করেছেন বেঞ্চমার্ক পিআরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফ কায়সার। প্রোফাইল লাল করার পর এক পোস্টে লিখেছেন, সরকারকে সিধা করতে হবে।
আশরাফ কায়সার কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন। শেখ হাসিনার পতনের আগে থেকেই তিনি আন্দোলনকারীদের পক্ষে ফেসবুকে সক্রিয় থেকে নিজের অবস্থান জানিয়ে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার আরেক পোস্টে তিনি লিখেছেন, যে জাতি শেখ হাসিনাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারে, সে জাতি সব অনিয়ম ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পারবে।
গত পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে আন্দোলনকারীরা প্রোফাইল পিকচার লাল করেছিলেন। প্রোফাইল পিকচার লাল করার ঘটনা প্রথম শুরু হয় গত ২৯ জুলাই। তখন কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবির দিকে ধাবিত হয়েছে। এরি মধ্যে কয়েকশো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনাও ঘটে যায়।
ওইদিন মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সরকারের সিদ্ধান্তে প্রহসন উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে লাল রং বেছে নেন। এর পরেরদিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই থেকে ফেসবুকে অনেকে প্রোফাইল পিকচার লাল করতে দেখা যায়। পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর লাল প্রোফাইল পিকচারে একাকার হয়ে যায়। লালে লাল দেখে অনেকেই জুলাইয়ের আন্দোলনকে লাল বিপ্লব বলেও অভিহিত করেন।
কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারেরও পতন হয়েছে। কিন্তু এখন আবার নতুন করে প্রোফাইল পিকচার লাল করা হচ্ছে কেনো?
গত ছিলো শহীদ নুর হোসেন দিবস। ওইদিন রাজধানীর জিরো পয়েন্ট অর্থাৎ নুর হোসেন চত্বরে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করতে মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিএনপিও আলাদাভাবে কর্মসূচি দেয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সেদিন আর নুর হোসেন চত্বরে তেমন দেখা যায়নি।
তবে ওইদিন সন্ধ্যায় ঘটে আরেক ঘটনা। নতুন করে শপথ নেন তিন উপদেষ্টা। এদের মধ্যে দুইজনকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। নতুন উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর স্ত্রী তিশা অভিনেত্রী। তিনি ’মুজিব: দ্য মেকিং অব এ নেশন’ সিনেমায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে রয়েছে তিশার ছবি। ফারুকীর ছবি রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে। আওয়ামী লীগকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয়ার পরই ফারুকী ও তিশার সেসব ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। তোপের মুখে পড়েন ফারুকী।
এদিকে শপথ নেওয়া আরেক উপদেষ্টা সেখ বসির উদ্দিনকে নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। শেখ বসিরের ভেই শেখ আপিল উদ্দিন যশোর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কয়েকবার এমপি হয়েছেন। গত জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিহত হন এক গার্মেন্টস শ্রমিক। সেই শ্রমিক হত্যার মামলায় নতুন উপদেষ্টা শেখ বসির আসামি বলে ছড়িয়ে বলে।
এ অবস্থার মধ্যেই নতুন উপদেষ্টাদের শপথের দিন বঙ্গভবনের উদ্দেশ্যে মশাল মিছিল করে ছাত্র-জনতা। সেই মিছিল থেকে ক্ষোভ জানানো হয়। এরি মধ্যে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ঝড় তোলেন ছাত্রনেতা সারজিস আলম। তিনি লেখেন, শুধু ১টা বিভাগ থেকে ১৩জন উপদেষ্টা ! অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টা জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই ! তার উপর খুনী হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে !
শনিবার রাতে সারজিস পোস্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে, রোববার আরেক স্ট্যাটাস দিয়ে মাঠ গরম ফেলেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি আন্দোলনের সময় গুলিতে দাঁত হারানো একজনের ছবি পোস্ট করে লেখেন, যা হারানোর উনারাই হারিয়েছেন। হাসিনা পুনর্বাসন প্রজেক্ট হাতে নেওয়ার আগে এই ছবিটা দেইখেন।
গত জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষ সহকারী মাহফুজও শনিবার, উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানে তার মাথার ওপর বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকায় ছাত্র আন্দোলনের নেতারা প্রশ্ন তোলেন। এরপর রোববার সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে পোস্ট দেন মাহফুজ।
আরও পড়ুন: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সমন্বয়ককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা
রাষ্ট্রপতির বাসভবন ও কার্যালয় বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামানোর নিন্দা জানিয়ে মঙ্গলবার নিজের মতামত জানান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, খন্দকার মোশতাকও তার ছবি নামিয়েছিলেন আর জিয়াউর রহমান আবার টাঙিয়েছিলেন সেই ছবি।
রিজভীর এই বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। অবশেষে নিজের বক্তব্য থেকে পিছু হটেন রিজভী। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তার আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। ফেসবুকে লেখেন, রাজনীতিবিদরা হাত মেলাচ্ছে, আর বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়ি এগিয়ে আসছে।
এই অবস্থার মধ্যে জুলাই আন্দোলনের প্রতীক ফেসবুকের লাল প্রোফাইল পিকচার আবার ফিরে আসা নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।