ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৪:২১ পিএম
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করা, আর সে কারণে এ মামলার আসামিরা কোনো ‘সহানুভূতি পেতে পারে না’ বলে পর্যবেক্ষণ এসেছে আদালতের রায়ে।
অভিজিৎ হত্যায় জিয়াসহ ৫ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড, ফারাবীর যাবজ্জীবন
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান মঙ্গলবার দপুরে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ছয় আসামির মধ্যে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পাঁচ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড এবং উগ্রপন্থি এক ব্লগারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন তিনি।
পদার্থবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তমনা ব্লগ সাইট পরিচালনা করতেন তিনি। জঙ্গিদের হুমকির মুখেও তিনি ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন।
একুশে বইমেলায় অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ বন্যাএকুশে বইমেলায় অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ বন্যা২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে জঙ্গি কায়দায় হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন অভিজিৎ রায়। চাপাতির আঘাতে আঙুল হারান তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর একের পর এক হামলা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে থাকেন মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, প্রকাশক ও অধিকারকর্মীরা।
২০১৯ সালে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আগের নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) নেতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়ার ‘নির্দেশেই’ সেদিন অভিজিতের ওপর হামলা হয়।
জিয়াসহ দুইজনকে পলাতক দেখিয়ে মোট ছয় আসামির বিরুদ্ধে এ মামলার বিচারকাজ চলে। মঙ্গলবার তাদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান।
৫০ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়, “সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে অভিজিৎ রায় একজন বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার ছিলেন। বাংলা একাডেমির বই মেলায় বিজ্ঞান মনস্ক লেখকদের আড্ডায় অংশগ্রহণ করে ফেরার পথে আক্রমণের শিকার হন।
“নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা, অর্থাৎ এ মামলার অভিযুক্তরাসহ মূল হামলাকারীরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করে । স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়।”
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার আদালতে আনা হয় আসামিদের। ছবি: মাহমুদ জামান অভিবিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগে মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার আদালতে আনা হয় আসামিদের। ছবি: মাহমুদ জামান অভিবিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, “অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হল জন নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ ও নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।”
আসামিদের সাজার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, “বাংলাদেশে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে মত প্রকাশ ও স্বাধীন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত আসামিদের কারো ভূমিকা ছোট বড় করে দেখার সুযোগ নেই।
“যেহেতু অভিযুক্ত পাঁচজন আসামি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, আকরাম হোসেন, মো. আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ও মো. আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসাবে সাংগঠনিকভাবে অভিজিত রায় হত্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন, সেজন্য ওই ৫ জন আসামির একই সাজা প্রদান করা হবে বাঞ্ছনীয়।”
বিচারক বলেন, “অভিজিৎ রায় হত্যায় অংশগ্রহণকারী অভিযুক্ত আসামিরা বেঁচে থাকলে আনসার আর ইসলামের বিচারের বাইরে থাকা সদস্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহী হবে এবং বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তমনা লেখকেরা স্বাধীনভাবে লিখতে এবং মতপ্রকাশ করতে সাহস পাবেন না। কাজেই উক্ত আসামিরা কোনো সহানুভূতি পেতে পারে না।”