গর্ভবতীদের টিকা: অনুমোদনে আছে 'সুরক্ষা'য় নেই

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ৯, ২০২১, ০৯:১২ পিএম

গর্ভবতীদের টিকা: অনুমোদনে আছে 'সুরক্ষা'য় নেই

অনুমোদন থাকলেও সুরক্ষা অ্যাপে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছে না গর্ভবতী মায়েরা। জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপ অনুযায়ী 'গর্ভবতী' অপশন নির্বাচন করে টিকার নিবন্ধন করতে গেলে "গর্ভবতী অবস্থায় টিকা গ্রহন করা যাবে না, গর্ভবতী অবস্থা পরবর্তী নিবন্ধন করুন" লেখা এসে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। 

আগস্ট মাসের শুরুতে (২ আগস্ট, ২০২১) গর্ভকালীন এবং মাতৃদুগ্ধ পান করানো মায়েদের টিকা দেয়ার অনুমোদন পেলেও, এখনও জাতীয় টিকা রেজিস্ট্রেশন প্রোগ্রাম 'সুরক্ষা' অ্যাপে গর্ভকালীন মায়েরা রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না। এই অবস্থায় জাতীয় টিকাদানে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ বছরের বেশি বয়সী মায়েরাও নিবন্ধন করতে পারছেন না নাগরিক নিবন্ধন অনুর্ধ্ব ২৫ বছরের ক্যাটাগরিতে। তার চেয়ে কম বয়সীদের টিকা গ্রহনের আগ্রহ থাকলেও হচ্ছেন বঞ্চিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গর্ভবতী এবং দুধ পান করানো মায়েদের টিকাদানের অনুমোদন আসার সিদ্ধান্ত জানতে পেরে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেবী রানী দাসের টিকা নিবন্ধন করার সিদ্ধান্ত নেন স্বামী জুয়েল তালুকদার। ত্রিশ বছর বয়সী স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও টিকা নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হন। জুয়েল তালুকদার দ্য রিপোর্টকে জানান, সুরক্ষা অ্যাপে নাগরিক নিবন্ধনসূচী (২৫ অনুর্ধ্ব) নির্বাচন করে চেষ্টা করি নিবন্ধনের। কিন্তু এসময় গর্ভবতী নির্বাচন করার পরেই সেটা লাল হয়ে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। আমার নিবন্ধন হয়েছে কিন্তু কেন আমার স্ত্রীর নিবন্ধন হচ্ছে না আমি বলতে পারব না। নিবন্ধন করতে গেলেই লেখা আসে গর্ভবতী অবস্থায় টিকা গ্রহন করা যাবে না।

জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে টিকা নিবন্ধন করতে গেলে দেখা যায়, সেখানে গর্ভবতীদের জন্য কোন ক্যাটাগরি নেই। স্বাস্থ্যকর্মী,আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিক, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে সুরক্ষা প্রোগ্রামে বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও গর্ভবতী মায়েদের নামের কোন তালিকা এখনও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি সেখানে। আবার সাধারণ নাগরিক নিবন্ধনের ক্যাটাগরিতে নিবন্ধন শুরু করলেও নিবন্ধন প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে 'গর্ভবতী' নির্বাচন করলে সেই নিবন্ধন সেখানেই বাতিল হয়ে যায়।

বিশ্বব্যাাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মহামারি আকার ধারণ করার পর থেকেই বয়স্ক নাগরিক এবং গর্ভকালীন মায়েরা অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এই বিবেচনায় টিকা আসার পর তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের পাশাপাশি অগ্রাধিকার তালিকায় গর্ভবতী এবং বয়স্কদেরও বিশেষ স্পর্শকাতর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের গর্ভকালীন এবং প্রসূতি মায়েদের টিকার নিবন্ধনে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও এই ক্যাটাগরিতে জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে রাখা হয়নি গর্ভরকালীন মায়েদের নিবন্ধনের বিশেষ কোন সুবিধা কেননা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল সরকার। ফলে সুরক্ষা অ্যাপে 'নাগরিক নিবন্ধন (২৫ তদুর্ধ্ব)’ এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে নিবন্ধন করছেন শুধুমাত্র ২৫ বছরের অধিক বয়সী প্রসূতি মায়েরা। আর তার কম বয়সীরা ছিটকে পড়ছেন টিকা গ্রহনের সুযোগ থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানেই সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা। গর্ভকালীন সময়ে এবং তার পরবর্তীকালে মায়েদের সঠিক পরিচর্যার কথা মাথায় রেখে অবশ্যই সুরক্ষা অ্যাপের টিকা নিবন্ধন তালিকায় গর্ভকালীন মায়েদের তালিকাভুক্ত করা উচিৎ। 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় পরামর্শক কমিটি চলতি আগস্ট মাসে অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী নারীদের টিকা দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। গর্ভবতী এবং বুকের দুগ্ধদান করানো নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং সুফলের মাঝে তুলনামূলক মূল্যায়নের মাধ্যমে ঝুঁকির চেয়ে সুফল অধিক বলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটি। 

বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত চিকিৎসকদের জাতীয় ফোরাম অবস্ট্রেট্রিক্যাল এন্ড গায়নিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) বেশ কিছুদিন আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গর্ভবতী মা এবং যারা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাদের টিকার আওতায় আনার আবেদন করে। এই দাবি অনুসারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় পরামর্শক কমিটি গর্ভকালীন এবং বুকের দুধ পান করানো মায়েদের টিকাদানের অনুমোদন দিয়েছে। এই সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডাক্তার ফেরদৌসী বেগম দ্য রিপোর্টকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অনেক উন্নত দেশে গর্ভবতী মায়েদের টিকার অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পাঁচটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে সেখানেও স্পষ্টভাবে গর্ভবতী মায়েদের টিকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখনও গর্ভবতী মায়েরা টিকা রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে গর্ভকালীন টিকা নিবন্ধন না করার বার’টি এখনও তুলে নেওয়া হয়নি। আমাদের সংগঠন থেকে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কে প্রস্তাবনা দিয়েছি জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপের তালিকায় গর্ভবতী এবং বুকের দুধ পান করানো মায়েদের নিবন্ধনের বিশেষ ব্যবস্থা রাখার জন্যে। যেহেতু জাতীয়ভাবে সরকার তাদের টিকাদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন উচিৎ হবে তাদের টিকা রেজিস্ট্রেশনের যথাযথ সহজ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।

জাতীয় সুরক্ষ অ্যাপ ব্যবহার করে গর্ভবতী মায়েরা টিকা রেজিস্ট্রেশন করতে না পারার কারণ এবং সেক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা হবে কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দ্য রিপোর্টকে জানান, অগ্রাধিকার তালিকায় আসবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা যে কয়টি টিকার অনুমোদন দিয়েছে সেখানে তারা বলেছেন,  গর্ভবতী মায়েদের টিকাদানের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য আমাদের জানা নেই ফলে যারা টিকা নিতে চান নিজ দায়িত্বে সেটা নিতে পারেন। 

২৫ বছরের উর্ধ্ব বয়সী গর্ভবতী মায়েরা টিকার নিবন্ধন করতে পারছে না বিষয়ে তিনি বলেন, তারা টিকা নিবন্ধন করতে পারবে। কেন নিবন্ধন করতে পারছে না খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। 

তার বিশ মিনিট পরেই আন্তরিকতার সাথে খোঁজ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক দ্য রিপোর্টকে নিশ্চিত করেন যে তিনি ক্রসচেক করে দেখেছেন গর্ভবতী মায়েদের টিকা নিবন্ধন করতে না পারার এ বিষয় জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপ থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই আবার দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে দেখা যায় জাতীয় সুরক্ষা অ্যাপে এখনও গর্ভবতীদের জন্য নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে।

Link copied!