সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ০১:২৬ এএম
চারদিনের সরকারি সফরে সোমবার (৫সেপ্টেম্বর) ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার এই সফরকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কুটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। এই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশের সাধারণ জনগনের মনেও রয়েছে নানা প্রত্যাশা। সরকারপ্রধানের এই ভারত সফরে দেশ নতুন কী আদায় করতে পারবে—ঘুরে ফিরে এই প্রশ্নও আলোচনা হচ্ছে।
আরও পড়তে পারেন: তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা দুঃখজনক,ভারতের আরও উদারতা দেখাতে হবে
ভারত আগেই জানিয়ে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক হবে না। চিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি আটকে আছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মতি না থাকার সীমানায়। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সফরে গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তিটিই হচ্ছে না, তাহলে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে নতুন করে কী আর আদায় করবে? আর আদায় হলে সেগুলো দেশের জন্য কতটুকেইবা মঙ্গলজনক হবে তা নিয়েও কুটনীতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এ বিষয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বললেন, ‘নানা অজুহাত আর লেম এক্সকিউজ দেখিয়ে ভারত তিস্তার পানি দিচ্ছে না৷ এবারও দেবে না তা আগেই সাফ বলে দিয়েছে। সামনে নির্বাচন আসবে, সেটাকে কারণ দেখিয়ে এই সমস্যাটা জিইয়ে রাখবে তারা।’
সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না উল্লেখ করে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব আরও বললেন, ‘তারা (ভারত) বলছে, সীমান্তে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এটি পৃথিবীর সব দেশের সীমান্তেই হয়ে থাকে। মোট কথা, ভারত যা চায় তা-ই পায়, আমরা যা চাই, তা পাই না। চাইলে তারা নানা অজুহাত দেখায় এবং দেয়ও না।’
বাংলাদেশ ক্রমশ চীনের দিকে ঝুঁকছে। ঢাকার এই বিষয়টি নয়াদিল্লি ভালভাবে দেখছে না। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সফর কী ভারতকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করার একটি কারণ— এমন প্রশ্নে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণের যে ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার পেছনে বাস্তব কারণ রয়েছে। দুই-একটি সফর দিয়ে তার অবসান হবে না। ভারতের সেক্রেফাইসিং মনোভাব থাকতে হবে। শুধু পাবো, দিবো না-এটোতো হতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি বন্টনসহ ৭টি চুক্তি ও সমঝোতা সই হবে। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক পানি ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রেলওয়ে, আইন, তথ্য ও সম্প্রচার, প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্পর্কিত বলে গতকাল রবিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন জানিয়েছেন।
এছাড়া, অভিন্ন বিভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হবে। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশ ভারত বৈঠকে তা স্পষ্ট হয়েছে। এছাড়া গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারেও আলোচনা হবে বলে জানা যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার ভারত সফরে এবার অর্থনেতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেগুলো থাকবে সেগুলো হল: সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি এবং সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) সই হওয়ার সম্ভাবনা। আর এটি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশের বাজারে শুল্ক ছাড়াই প্রবেশের সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ এরইমধ্যে এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। পাশপাশি বাংলাদেশ এন্টি ডাম্পিং নীতি নিয়েও কথা বলবে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘আমরা যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যকে সঠিক বলে ধরে নিই তাহলে তো আর কিছু বলার নেই৷ বিষয়টা হলো ভারতের সাথে আমাদের সব সময়ই কথা হয়, আলাপ আলোচনা হয়। এটা তো রুটিন কাজ। কিন্তু অর্জন কী হয়, সেটাই প্রশ্ন। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের এই সাবেক রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশি দেশ। নির্বাচনের আগে যেহেতু এই সফর, তাই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তবে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো তাতো জানা যাবে না। কারণ রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ তো আর মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয় না।’
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দিক দিয়ে শেখ হাসিনার এই ভারত সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সুম্পর্ক আছে। তবে এই দু’দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক হতে হবে সমতার ভিত্তিতে৷ ভারতকে আমরা যেরকম সুযোগ সুবিধা দিই,সেরকম সুযোগতো আমাদেরও চাওয়ার অধিকার রয়েছে। সুযোগ-সুবিধাটা সুষম হতে হবে।’
একই মত পোষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। কিন্তু আরো ছয়-সাতটি নদীর পানি নিয়েও তো ভারতের কোনো আগ্রহ দেখি না৷ আমরা আগ্রহ দেখালেও তাদের আগ্রহ খুবই কম।’
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনসহ তিস্তার বিষয়টিও জোরালোভাবে তুলে ধরা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এবার সেপা চুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়ে ভারতের যে মনোভাব তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরই ধারাবাহিকতায় সফরের প্রথম দিনই (৫ সেপ্টেম্বর) শেখ হাসিনা ভারতের কূটনীতিকদের সাথে মত বিনিময় করবেন। দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এ আয়োজন করেছে বলে জানা গেছে।
অগামীকাল মঙ্গলবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। দুই নেতার যৌথ ঘোষণায় ঢাকা-দিল্লির সুসম্পর্কের বিষয়টি ফোকাস করা হবে বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারত সফর করেন। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২১ সালের মার্চে সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সময়ই মোদী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে গিয়েছিলেন।