মাতৃত্বের ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়েছে সিজারিয়ান ডেলিভারি ও অদক্ষ পরিচর্যাকারী। সচেতনতার অভাব ও স্বাস্থ্য খাতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকার পাশাপাশি অর্ধেকের বেশি সন্তান প্রসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে। আর করোনা সংক্রমণের কারনে মাতৃত্ব আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়ছে
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিজারিয়ান প্রসবের সংখ্যা শতকরা ৩১ ভাগ, যা বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত হারের দ্বিগুনেরও বেশি৷ তাদের নির্ধারিত হার অনুযায়ী, এই সংখ্যা মোট প্রসবের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এছাড়া মেডিকেল ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে৷ এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে৷ সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে৷ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি৷
ক্লিনিকের ব্যবসার বলি মাতৃত্ব
ক্লিনিকের ব্যবসায়িক চিন্তার বাদেও নানা কারণে সিজারিয়ানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, দেশের ৯৫ শতাংশ ক্লিনিকের আয়ের উৎস প্রসবকেন্দ্রিক। যার ফলে তারা সিজারিয়ানে জোর প্রদান করে। কিন্তু সেখান সিজার করতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয় গড়ে। এটা এখন বাণিজ্যিক হয়ে গিয়েছে।
সিজারিয়ানের দুষ্টু চক্রে পড়ছে মাতৃত্ব উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, প্রথমবার যেহেতু লক্ষ লক্ষ মায়ের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান হয়ে গেছে, তখন দ্বিতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রেও তাদের সিজার হবে৷ সে কারণে রেটটা দিন দিন বাড়তে থাকবে৷
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব হেলথ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে প্রকাশিত আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় বলা হয়, বাধ্য হয়ে সিজারিয়ান করানোর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর বড় রকমের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে বলে উঠে এসেছে।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে তাদের গড়ে খরচ পড়ছে ২৫০ ডলার, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যে খরচ মাত্র ৬০ ডলার৷ এভাবে বাচ্চা প্রসবে খরচ বৃদ্ধি বাংলাদেশের ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার' অর্জনে বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ওই গবেষণায়৷
করোনায় বাড়ছে মাতৃত্বের ঝুঁকি
সরকারের হিসাব মতে করোনাকালে ৯ শতাংশ কমেছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব। সরকারের হিসাব মতে, দেশে ৫০ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের আওতায় ছিল। কিন্তু করোনার প্রভাবে তা কমে আসে। সর্বশেষ ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’(এমআইএস) রিপোর্ট মতে, এই হার বর্তমানে ৪১ শতাংশ। করোনার কারণে কমেছে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের চিকিত্সাকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার হার। করোনাকালে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এমন তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচি ইপিআই।
জনস্বাস্থকর্মী ইশতিয়াক মান্নান বলেন, প্রতিবছরে দেশে ৪৭ শতাংশ প্রায় ১৭ লাখ মা এখনো অদক্ষ পরিচর্যাকারীর হাতে সন্তান জন্ম দেন। বাংলাদেশে ৩২ শতাংশ যা প্রায় ১১ লাখ ডেলিভারি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালে হয়, যেগুলো কার্যকর অর্থে মান-নিয়ন্ত্রণহীন। কিন্তু মা কিংবা অন্যান্য পরিচর্যাকারীর নিশ্বাস, হাঁচি, কাশি কিংবা জীবাণুবাহী স্পর্শের মাধ্যমে নবজাতকের আক্রান্ত হবার আশঙ্কা পুরোমাত্রায় রয়েছে।
যে ৫০ শতাংশ মা হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই হাসপাতালের পরিবেশ এবং সেবাদানকারীদের মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবেন, যে ঝুঁকি শুরু হচ্ছে গর্ভকালীন সেবার সময় থেকে।
শিক্ষিতদের মধ্যে সিজারিয়ানের হার বেশি
আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মায়েরা অন্যদের তুলনায় বেশি খরচ করছেন৷ অন্যদিকে, শহুরে নারীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত এবং জন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন, তাঁরাও এই বেশি খরচের পথই ধরছেন৷