আবাসিক হল বন্ধ রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সশরীরে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় না রেখেই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে দাবি শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার আনন্দের পাশাপাশি হল বন্ধ রেখে সশরীরে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু হল বন্ধ রাখলে সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে না বলে মত দিয়েছেন ছাত্র নেতারা।
ডাকসুর সাবেক নির্বাচিত সদস্য এবং ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবা সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, এ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি শিক্ষার্থী স্বার্থের পরিপন্থী। প্রশাসন শিক্ষার্থীবান্ধব না তারই প্রমাণ বহন করে এটি। আমি চাই পরীক্ষা হোক, তবে সেটা হল খুলে সশরীরে হতে হবে।
তিনি ভিন্ন প্রস্তাব রেখে বলেন, অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা মেনে নিব। তবে সকলের জন্য সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। …তবে অনেকদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছে, ক্যাম্পাস খুলে পরীক্ষা নেওয়ার বিকল্প নেই।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা চাই হল খুলে পরীক্ষা নেওয়া হোক, এছাড়াও আমাদের আরেকটা দাবি, সকল শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার পর হল ও ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া। কিন্তু টিকা কার্যক্রম যেহেতু বারবার পিছিয়েছে, তাই আমরা চাই যেন ক্যাম্পাস ও হল খুলে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত এ এফ রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম পলাশ বলেন, এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ব্যর্থতার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারবে না। এই প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রীর সাথে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় নেই। সমন্বয় নেই নিজেদের মধ্যে কিংবা শিক্ষার্থীদের সাথেও।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরাট একটা অংশ অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে হল খুলে পরীক্ষা দিতে চাইছে। যদি আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেয়া হয়, তাহলে এই শিক্ষার্থীরা ঢাকায় এসে নানামুখী সমস্যায় পড়বে। এ থেকে হতাশা ও অবসন্নতায় ভোগাও অস্বাভাবিক নয়। ফলে আত্মহত্যা অতিমারি আকার ধারণ করতে পারে।’
অনলাইনে পরীক্ষা দেয়া অসম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডিভাইস সঙ্কটের কারণে অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশই নিতে পারেনি। এখন যদি ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাদের কি হবে? একজন শিক্ষার্থীও যদি ডিভাইসের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারে, কিংবা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ে তাহলে আমি বলবো এটি প্রশাসনের ব্যর্থতা।
পহেলা জুন ঢাবি কর্তৃপক্ষ আবারও আবাসিক হল বন্ধ রেখে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এ ঘোষণার ফলে শিক্ষার্থীমহলে প্রতিবাদ এবং আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
করোনা মহামারীর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার পূর্বে তাদের নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মু. আক্তারুজ্জামান জানান, নিরাপত্তার বিষয়ে আলাদা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
সশরীরে পরীক্ষা দেয়ার আদেশ বলবৎ রাখছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন কোন সিদ্ধান্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা জানানো হবে।
করোনার সংক্রমণ চলছে, এছাড়াও শিক্ষার্থীদের নানা ধরণের সঙ্কট তো রয়েছেই, এই পরিস্থিতিতে ঢাকার বাহিরের জেলা থেকে শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন ঝুঁকির আশঙ্কা আছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফারজানা আকমাম মুন বলেন, আবাসিক হল বন্ধ রেখে সশরীরে ফাইনাল পরীক্ষা হবে শুনে আমরা ছয়জন বন্ধু নিজ এলাকা থেকে ফিরে লালবাগে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। ওইখানে চলাফেরা করার সময় প্রায়ই ইভটিজিং এর শিকার হতে হতো। এ ছাড়া বাসার নিচতলায় মানসিকভাবে এক অসুস্থ লোক মেয়েদের অন্তর্বাস চুরি করতো। আমাদের অনেক বান্ধবীও বাইরে এ ধরণের নানা পরিস্থিতির শিকার। এসব নানা কারণে আমরা বাইরে থাকতে নিরাপদ অনুভব করতাম না, এমনটা হলে কখনো অনুভব করিনি।
মুন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনচেতা শিক্ষার্থীরা কখনোই এগুলো মেনে নিতে পারে না। এমন পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে চলতে চলতে যখন শক্তি শেষ হয়ে যায় তখন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার মনে করে বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে যে কত কত বন্ধুর বিয়ে হতে দেখলাম, আর তারপর সেই স্বামী বা তার পরিবারের সাথে মানিয়ে না চলতে পারার ফল হয়েছে অমানবিক অত্যাচার, যার ফলাফল সুইসাইড অথবা খুন।
তিনি আরও বলেন, এ তো যারা পরিচিত তাদের কথা বলছি। প্রত্যেকের কাছে এরকম কিছু নৃশংস ঘটনা জানতে পারা যাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং ভিসি মহোদয় শুরু থেকেই ছাত্রবান্ধব আচরণ করেননি। এসকল মৃত্যু অথবা আমার ট্রমা গুলোর দায় কে নেবে?
করোনার প্রকোপের এই সময়ে সবারই আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিফাত তাসনিম বলেন, করোনার এই সময়ে হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। আর্থিক দৈন্যতার এই সময়ে শিক্ষার্থীরা কিভাবে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে? এছাড়া আমরা হলগুলোয় খাওয়া দাওয়ার যেই সুযোগ সুবিধা পাই সেগুলো কি অন্য কোথাও পাব?
এ ছাড়াও আবাসিক হল বন্ধ থাকলে যে শিক্ষার্থীরা বাইরে থাকবে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতে হবে গণপরিবহনের মাধ্যমে। এতে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আরো বাড়বে বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষার্থী।
তিনি আরো বলেন, আমি রাজশাহী শহরেই থাকি তাও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট নেই। আর যারা গ্রামে থাকেন তাদের অবস্থা কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের অধ্যয়নরত মহসিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রিফাত জাহান শাওন বলেন, আমি চাই পরীক্ষা হোক, তবে সেটি যেন কোনোভাবেই আবাসিক হল বন্ধ রেখে না হয় তার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের মধ্যে গ্রাম থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন তাদের ঢাকায় থাকার মতো সুব্যবস্থা নাই।
তিনি আরো বলেন, আমাদের অনেকের ডিভাইস নাই, আবার নেটওয়ার্কের সমস্যা সেদিক বিবেচনায় অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্তও ফলপ্রসূ হবে না। তাই আমি চাই কিছুদিন পরে হলে হলখুলে সশরীরে পরীক্ষা নেওয়া হোক।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমবার আবাসিক হল বন্ধ রেখে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার কথা ঘোষণা করে। তবে সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে তারা সে সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায়।