করোনায় স্কুলবঞ্চিত ৪০ লাখ শিশু

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ২৯, ২০২১, ১১:৫৭ পিএম

করোনায় স্কুলবঞ্চিত ৪০ লাখ শিশু

৫ বছরের মরিয়ম আক্তার। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াইডব্লিইসিএ হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুলের প্লে-গ্রুপে ভর্তি হয়। মাসের শুরুতে তার ক্লাস শুরু হলে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া-আসা  করতো সে। ভর্তির মাত্র একমাস পরেই মার্চ মাসে কোভিড-১৯ মহামারি এসে সব এলোমেলো করে দেয়। ফলে মরিয়ম বঞ্চিত হয় তার শিক্ষা জীবনের প্রথম ক্লাস করা থেকে। আর কোনদিন হয়তো করাও হবে না। মরিয়ম ছাড়াও  বাংলাদেশে আরো প্রায় ৪০ লাখ শিশু যারা গত বছরে তাদের শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলো তারাও তাদের জীবনের প্রথম ক্লাসটি করতে পারেনি।  

এই রিপোর্টারের সাথে টেলিফোনে আলাপকালে মরিয়ম জানান, সে অনলাইনে ক্লাস করার চেয়ে তার নতুন বিদ্যালয়ে যাওয়া আসাই বেশি উপভোগ করছিলো। মরিয়ম বলেন, ‘স্কুলে আমার দুজন নতুন বন্ধু আছে। প্রতিদিন তাদের সাথে খেলতে আমার খুব ভালো লাগতো। এখন আমার স্কুল বন্ধ। আমি তাদের সঙ্গে এখন আর খেলতে পারছি না। আমাকে সারাদিন আমার ঘরে বসে থাকতে হয়। কোনকিছুই আর ভালো লাগে না।

কেবল মরিয়ম নয় তার মতো লাখো শিশু আছে যাদের গল্পটাও মরিয়মের মতোই। অবাক শোনাতে পারে কিন্তু বাস্তবতা হলো ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কয়েক লাখ শিশুই তাদের শিক্ষা জীবনের প্রথম ক্লাসটি করতে পারেননি।

সম্প্রতি ইউনিসেফ ‘জীবনের প্রথম ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে সারা বিশ্বে ১৪ কোটি শিশুর’-শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয় এই ১৪ কোটি শিশুর মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ শিশু বাংলাদেশের। এরা তাদের জীবনের প্রথম ক্লাসটি করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের সবগুলো দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।

ইউনিসেফের রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর অপরাধ, বাল্য বিবাহ এবং শিশু শ্রমে জড়ানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজির অধ্যাপক নাফিজা ফেরদৌসি বলেন, এখন শিশুদের সরাসরি ক্লাসের পরিবর্তে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে হওয়ায় এবং ক্লাস অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গাজীপুরের রোশান আরাবি ঊষ্ণ (০৫) সম্প্রতি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। কিন্তু কোভিডের কারনে এখনো তার নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সরাসরি ক্লাস করার ও তার সহপাঠিদের সাথে খেলাধুলা করার সুযোগ পায়নি।

ঊষ্ণর মা রেজওয়ানা নশিন এই প্রতিবেদককে বলেন, বাচ্চারা তার বন্ধুদের সাথে চলাফেরার মাধ্যমে সামাজিক হতে শেখে। কিন্তু কোভিডের কারণে আমার ছেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে না ফলে সে দিনকে দিন আরো ইন্ট্রোভার্ট হয়ে যাচ্ছে সে। এতে তার মানসিক বিকাশ ব্যহত হচ্ছে।

বন্ধের সময় শিক্ষা ব্যবস্থা চলামান রাখতে সরকারের তরফ থেকে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ কতোটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংসদ টিভিসহ

অনলাইনে নানাভাবে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরিা বলছেন, কেবল উপযুক্ত সরঞ্জামের অভাবে অধিকাংশ শিশুই অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি।  

গত বছরের জুলাই মাসে বিশ্ব ব্যাংক পরিচালিত এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর টিভি দেখার সামর্থ্য আছে, ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টিভি দেখতে পারে এবং মাত্র ৩৪.৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন ব্যবহারের সামর্থ্য আছে। কম্পিউটার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কম, মাত্র ৩ শতাংশ।

বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি ডিরেক্টর রিফাত বিন সাত্তার বলেন, ‘সরকার অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে নানা পদক্ষেপ নিলেও অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অধিকাংশ শিশু ও তার পরিবারের নেই। এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব শিশুদের উপর পড়ছে। সেভ দ্য চিলড্রেন শিশুদের একটি ভালো শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।  

Link copied!