মে ২১, ২০২৪, ০৩:১৮ পিএম
ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস দেশের কোমল পানীয়র বাজারে অনেকটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কিন্তু অনুমোদন ছাড়াই এই ধরনের ড্রিংকসগুলো বাজারজাত করায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। এছাড়া ধীরে ধীরে বাজার থেকে তাদের সরবারহকৃত পণ্য তুলে নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয় পরবর্তীতে।
প্রশ্ন থেকে যায় প্রায় ৩ বছর ধরে অনুমোদন ছাড়া এই পণ্য কীভাবে বাজারজাত হয়?
রাফসানে ব্লু কেন নেই মামলার তালিকায়
বর্তমানে সাতটি প্রতিষ্ঠান এই ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বাজারজাত করছে। তবে এর মধ্যে আলোচিত ইউটিউবার রাফসান যিনি রাফসান দ্য ছোট ভাই নামে পরিচিত তার ‘ব্লু’ নামের একটি ড্রিংকস আছে। কিন্তু মামলার তালিকায় তার নাম না থাকায় দেখা যায় ধোঁয়াশা।
ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস নিয়ে যে মামলা হয়েছে তার বিপরীতে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পরবর্তীতে আদালত যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা পালন করবো
- ইলিয়াছ মৃধা
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাণ গ্রুপ
এদিকে গত ২৪ এপ্রিল কুমিল্লায় তার কারখানায় নোংরা পরিবেশ ও মোড়কের নিবন্ধন না থাকায় জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার বিরুদ্ধে মামলা না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায় বিএসটিআইয়ের কাছে কোনো আবেদনই করেননি তিনি।
কোনো পণ্য বাজারজাতের আগে মূলত বিএসটিআইয়ের কাছে আবেদন করতে হয়। সেই পণ্যের বিপরীতে নির্দিষ্ট কোড থাকায় বিএসটিআই আবেদন যাচাই-বাছাই করে সম্মতি দেয়। ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসের বিপরীতে কোনো কোড না থাকায় অনুমোদন দেয়নি বিএসটিআই। আর পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করায় বাজারে থাকা এই পণ্যের ওপর ভিত্তি করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ মামলা করে। কিন্তু রাফসানের ‘ব্লু’ মূলত বাজারে সহজলভ্য না থাকায় কোনো স্যাম্পল পায়নি নিরাপদ খাদ্য। এই কারণেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।
অনুমোদন দেবে কোন প্রতিষ্ঠান?
একমি ও এসএমসি কোম্পানির এসএমসি প্লাস, প্রাণের অ্যাক্টিভ, ব্রুভানা বেভারেজ লিমিটেডের ব্রুভানা, দেশবন্ধু ও আগামী কোম্পানির রিচার্জ এবং আকিজের টারবো, রাফসানের ব্লু ও বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের বিএমটিএফ নামে ড্রিংকস বাজারজাত করছে। ২০২১ সালে অনেকটা হুট করেই এসএমসি প্লাস বাজারজাতের পরই অন্য প্রতিষ্ঠানও বাজারজাত শুরু করে।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, “চলতি বছর জানুয়ারিতে আমরা বিএসটিআইয়ের কাছে একটা চিঠি দিয়েছিলাম আমাদের অ্যাক্টিভ প্লাস পণ্যটির মান প্রণয়নের জন্য। কিন্তু সেখান থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।”
বিএসটিআইয়ের কাছে কোনো আবেদনই করেননি রাফসান
বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক মো. রিয়াজুল হক বলেন, “ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বাধ্যতামূলক পণ্যের আওতায় পড়ে না। এর বিপরীতে আমাদের তালিকায় কোনো কোডও নেই। তাই যারাই আবেদন করেছে তাদেরকে আমরা অনুমোদন দিইনি।”
এদিকে চিকিৎসকদের মতে এই ধরনের ইলেক্ট্রোলাইট পণ্যের উপাদানগুলো অনেকটাই প্রচলিত স্যালাইনের মতো। তাই স্যালাইন খাওয়ার ঝুঁকি বিবেচনায় এটার অনুমোদনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন হবার কথা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস অনুমোদনের জন্য আমাদের কাছে আবেদন করেনি। অনুমোদন নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না।”
৫ টাকার স্যালাইনে নামে ৬০ টাকার ড্রিংকস
বাজারে এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খাবার স্যালাইন ৫-৬ টাকা মূল্যে পাওয়া যায়। এছাড়া সেখানে বিভিন্ন ফ্লেভারের স্যালাইনও পাওয়া যাচ্ছে। এই স্যালাইনের উপাদানে যদি লক্ষ্য করি সেখানে সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম ক্লোরাইড, ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট ডাইহাইড্রেট ও এনহাইড্রাস গ্লুকোজ (সাধারণ চিনি) আছে।
বাজারে যদি বিদ্যমান ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসের উপাদান খেয়াল করি তবে এসএমসি প্লাসে রয়েছে সোডিয়াম সিট্রেড, সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, গ্লুকোজ এনহাইড্রোস, চিনি ও সাইট্রিক এসিড। অর্থাৎ ওরাল স্যালাইনের সমউপাদান। এদিকে রাফসানের ‘ব্লু’তে সাইট্রিক এসিড, ডেক্সট্রোজ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম ও পটাসিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। অর্থাৎ এটিও সাধারণ ওর্যাল স্যালাইনের মতোই।
কিন্তু একটি পাঁচটা মূল্যের ওরাল স্যালাইন ৫০০ মি.লি পানিতে মিশিয়ে পান করা যায়। সেখানে ৫০০ মি.লি ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসের মূল্য ৬০ টাকা। আর ২৫০ মি.লির মূল্য ৩৫ টাকা। ফলে ৫ টাকা মূল্যের এই পণ্য ৬০ টাকা দরে ক্রেতারা ক্রয় করছে।
কিডনি বিকলের সম্ভাবনা
সাধারণত ডায়রিয়া (উদরাময়), পানি শূন্যতার পাশাপাশি অত্যাধিক পরিশ্রমকারী ও অনুশীলন করলে ওরাল স্যালাইন নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। কিন্তু এই ওরাল স্যালাইন অতিরিক্ত নিলে দেখা দিতে পারে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি। যার প্রথম প্রভাব আসে মানুষের কিডনিতে। তেমনি একই উপাদান থাকায় ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসের রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
পরিস্থিতি এমন হয় যে কয়েকগুণ বেশি দামে কালো বাজারে বিক্রি হতে থাকে ‘প্রাইম’। এতই জনপ্রিয় হয় যে নকল পণ্যও বাজারে সয়লাভ হয়ে যায়। ফলে সাধারণ ভোক্তাদের মাঝে এই ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বাজারজাতের সম্ভাবনা দেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের (কিডনি রোগ) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “বাজারে বিদ্যমান ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসে বিভিন্ন ধরনের লবণের উপস্থিতি দৃশ্যমান। এই পানীয় যদি কেউ অতিরিক্ত খায় তাহলে তার কিডনিতে প্রভাব পড়তে পারে। সেই সঙ্গে রক্তে সোডিয়াম, পটাসিয়ামের মাত্রা বেড়ে খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।”
কেউ যদি অতিরিক্ত এই ধরনের পানীয় পান করে থাকে তাবে আপাতত চিকিৎসকের শরাণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
নেই সতর্কবার্তা, ঝুঁকিতে যারা
এদিকে বাজারে বিদ্যমান ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসে এই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কোনো সতর্কবার্তা নেই। সেই সঙ্গে কারা কারা এই ধরনের পানীয় পান করবে তারও কোনো দিক নির্দেশনা দেওয়া নেই। শুধু এসএমসি প্লাসের প্যাকের গায়ে লেখা আছে ‘ডায়েবেটিস (বহুমূত্র বা মধুমেয়) রোগীর জন্য নয়’। এটা ছাড়া বাজারে বিদ্যমান কোনো প্রতিষ্ঠান দেয়নি সতর্কবার্তা। সেই সঙ্গে এই ধরনের কোনো পানীয়ে বিএসটিআইয়ের সিল নেই।
স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সালেহউদ্দিন মাহমুদ তুষার বলেন, “বিশ্বে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস স্পোর্টস খাতে বেশি জনপ্রিয়। খেলোয়াড়রা অনুশীলন করলে শরীরে যখন অনেক ঘাম হয় তখন যে লবণ বেরিয়ে যায়, এর ঘাটতি পূরণের উপাদানগুলো ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসে আছে। কিন্তু সুস্থ মানুষ নিয়মিত খাবার ও পানির মাধ্যমে এই লবণ পেয়ে থাকে। সে জন্য তাদের এমন পানীয়ের প্রয়োজন হয় না।”
ফলে কোনো সুস্থ মানুষ যদি এই ধরনের পানীয় পান করে তবে তারা ঝুঁকিতে আছে। সেই সঙ্গে ডায়েবেটিসে (বহুমূত্র বা মধুমেয়) আক্রান্ত রোগী, শিশু ও প্রবীণরাও এই ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস পান করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, “মূলত আমরা সুলভ মূল্যে স্যালাইন খাবার পরামর্শ দিয়ে থাকি যাদের ডায়রিয়া (উদরাময়), বমি ও পানিশূণ্যতা রয়েছে। কিন্তু এই ইলেক্ট্রোলাইট পণ্যের মার্কেটিংয়ের ফলে সবাই স্বাভাবিকভাবে এটি পান করছে, স্বাস্থ্যের জন্য যা ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।”
স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও বিশ্বে এত ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস কেন
ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় এবং দ্রুত বর্ধনশীল কার্যকরী পানীয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক যেমন Gatorade (PepsiCo), POWERADE (Coca-Cola), Rebalanz (Dr. Reddy’s) প্রভৃতি বহুল ব্যবহৃত ও ব্যাপক জনপ্রিয়।
এই প্রসঙ্গ টেনেই প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, “ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস নিয়ে যে মামলা হয়েছে তার বিপরীতে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পরবর্তীতে আদালত যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা পালন করবো।”
এদিকে বিশ্বে ইলেক্ট্রোলাইট পণ্যের কোথাও অনুমোদন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এই ইলেক্ট্রোলাইট পণ্যের কোনো অনুমোদন দেয়নি। তবে এর বাজারজাত করা নিয়েও হস্তক্ষেপ করেনি তারা। তবে বিশ্বব্যাপী এই ধরনের পানীয় শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যে গ্রহণের প্রবণতা দেখা যেত। তবে এই প্রেক্ষাপট বদলে যায় ২০২২ সালে।
২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি বিখ্যাত ইউটিউবার লোগান পল ও কেএসআই ‘প্রাইম’ নামে একটি পণ্য বাজারজাত শুরু করে। ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করে অল্প সময়েই জনপ্রিয়তার অর্জন করে জনসাধারণের মাঝে।
মূলত আমরা সুলভ মূল্যে স্যালাইন খাবার পরামর্শ দিয়ে থাকি যাদের ডায়রিয়া,বমি ও পানিশূণ্যতা রয়েছে। কিন্তু এই ইলেক্ট্রোলাইট পণ্যের মার্কেটিংয়ের ফলে সবাই স্বাভাবিকভাবে এটি পান করছে, যা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে
- অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম
সাবেক চেয়ারম্যান, নেফ্রোলজি বিভাগ (কিডনি রোগ)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
পরিস্থিতি এমন হয় যে কয়েকগুণ বেশি দামে কালো বাজারে বিক্রি হতে থাকে ‘প্রাইম’। এতই জনপ্রিয় হয় যে নকল পণ্যও বাজারে সয়লাভ হয়ে যায়। ফলে সাধারণ ভোক্তাদের মাঝে এই ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বাজারজাতের সম্ভাবনা দেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশের ইউটিউবারও এই ‘প্রাইম’ ড্রিংকসের আদলেই গড়ে তুলেছিল তার ব্র্যান্ড ‘ব্লু’।