ছবি: সংগৃহীত
শ্রমিক! শব্দটা ছোট, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে অসীম সহ্যশক্তি, অজস্র বিসর্জন, আর এক মহৎ সংগ্রামের ইতিহাস।
এই সংগ্রামেরই এক রক্তাক্ত পৃষ্ঠা হলো মে দিবস। এটি নিছক কোনো উৎসবের দিন নয়, কেবল ছুটির দিনও নয়। এটি সেই দিনের কথা বলে, যেদিন কিছু মানুষ বলেছিল —“আমরা মানুষ, আমাদেরও সময় চাই —কাজের জন্য, বিশ্রামের জন্য, আর স্বপ্ন দেখার জন্য।”
ভাবুন তো, কেউ একজন কারখানায় কাজ করেন। সকাল হতেই ঢুকে যায় গরম, ধোঁয়ায় ভরা এক ঘরভর্তি যন্ত্রের মধ্যে। সূর্য ডুবে যায়, তবু কাজ ফুরোয় না। এমন একটা সময় ছিল শ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না —১২ ঘণ্টা, কখনো ১৪, এমনকি ১৬ ঘণ্টা। খাওয়া, বিশ্রাম বা পরিবারের মুখ দেখা —এসব যেন বিলাসিতা।
এই অমানবিক অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল একদল মানুষ — যারা স্বপ্ন দেখতো ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা নিজের মতো করে বাঁচার সময়।
১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হাজার হাজার শ্রমিক একসাথে রাস্তায় নেমে এলেন এই দাবিতে। তারা শুধু নিজেদের নয়, দুনিয়ার সব শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়ালেন। শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলন রূপ নেয় ভয়াবহ রক্তাক্ত সংঘর্ষে, যা পরিচিত ‘হে মার্কেট হত্যাকাণ্ড’ নামে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেশ কয়েকজন শ্রমিক, আর আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে অনেকেই পরে মৃত্যুদণ্ড পান।
কিন্তু এই ঘটনা থামাতে পারেনি ইতিহাসকে। বরং এই আত্মবলিদান ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এই বিপ্লবী চেতনা বিশ্বকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়।
ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস, ক্লারা জেটকিনের মতো নেতারা সে বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারা পৃথিবীতে।
১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস। সেখানে ফরাসি সমাজতন্ত্রী রেমন্ড লাভিনে প্রস্তাব করেন—১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ মে হে মার্কেটের শহীদদের স্মরণে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হোক ‘শ্রমিক দিবস’। ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯০৪ সালে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তাতে বলা হয়, প্রতি বছর ১ মে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। এই সম্মেলনে আরও বলা হয়—যেখানে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, সেখানে ১ মে ‘কাজ না করার’ দিন হিসেবে পালন করতে হবে।
এই আহ্বান সাড়া ফেলে দেয় বিশ্বজুড়ে। অনেক দেশেই শ্রমজীবী মানুষ ১ মে-কে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি জানায় এবং বহু দেশে তা কার্যকরও হয়।
বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা প্রভৃতি দেশে মে দিবস হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত, এমনকি আয়োজিত হয় সামরিক কুচকাওয়াজও। আমাদের উপমহাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে।
বাংলাদেশেও মে দিবস গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন দিনটিকে শ্রদ্ধা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে স্মরণ করে। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়, ছুটির দিন হিসেবে গণ্য হয়।
মে দিবস শুধুই আনন্দের দিন নয়, এটি এক গভীর রাজনৈতিক ও মানবিক দাবির দিন। শিকাগো শহরের সেই সংগ্রাম শুধু ‘৮ ঘণ্টা কাজ’ বলেই থেমে যায়নি। বরং এ ছিল এমন এক দাবি — যা বলে, কাজের সময় কমাও, যেন মানুষ তার জীবনের অর্থ খুঁজে পায়।
‘৮ ঘণ্টা সংগ্রাম’ বলার অর্থই হলো — শ্রমিক যেন তার মানবিক মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, রাষ্ট্রে তার অংশিদারিত্বের দাবি জানাতে পারে। যেন সে শুধুই শ্রম বিক্রেতা নয়, এক স্বাধীন মানুষ, যার চিন্তা আছে, স্বপ্ন আছে।
মে দিবস কেবল ইতিহাস নয়, এটি ভবিষ্যতের চুক্তিপত্র। সে চুক্তিতে লেখা আছে — একদিন এমন এক সমাজ গড়া হবে, যেখানে শ্রমিক শুধু কলের চাকা ঘোরানো হাত নয়, বরং মাথা তুলে দাঁড়ানো, সম্মানের সঙ্গে বাঁচা এক মানুষ।