সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫, ০১:৫৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন স্মরণে ঘোষিত ছুটির দিনটি অনেকে গ্রীষ্মের রোদ উপভোগ করে কাটিয়েছেন। আরেকদল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়েছে নানা জল্পনা, কল্পনা। সেটি হলো- প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি মৃত্যুশয্যায়, কিংবা আরও ভয়াবহ কিছু ঘটেছে।
গত সোমবার এক্স-এ ট্রেন্ড ছিল ‘ট্রাম্প ইজ ডেড’ ও ‘হোয়ার ইজ ট্রাম্প’ হ্যাশট্যাগ। টিকটকে লাখো মানুষ ভিডিও বানিয়েছেন বা দেখেছেন। যেখানে দাবি করা হয়, ট্রাম্প নাকি মারা গেছেন, স্ট্রোক করেছেন অথবা গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মারা যাননি। গত মঙ্গলবার তিনি হোয়াইট হাউসে সরাসরি বক্তব্য দিয়েছেন। গণমাধ্যমের সামনেও এসেছেন। ট্রুথ সোশ্যালে তার পোস্টে মন্তব্য করেছেন হাজারো মানুষ। ফক্স নিউজের সাংবাদিক পিটার ডুসি ওভাল অফিসে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি নাকি মারা গেছেন? দেখেছেন সেসব?’ জবাবে ট্রাম্প বলেন, এসবের কিছুই তিনি দেখেননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমি দেখিনি, তবে শুনেছি। বিষয়টা একরকম পাগলামি। গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটি সংবাদ সম্মেলন করেছি। এরপর দুইদিন কোনো সংবাদ সম্মেলন করিনি, আর তখনই বলা শুরু হলো, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে।
ট্রাম্পের সত্যিই একটি শারীরিক জটিলতা আছে। তবে তা জীবনসংকটের নয়। তিনি মারা গেছেন বা মৃত্যুপথযাত্রী- এমন ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে ছিল- সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের একটি বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন। এ ছাড়া, ট্রাম্পের হঠাৎ নীরবতা, স্বাস্থ্যের জটিলতা নিয়ে ইনফ্লুয়েন্সার বা প্রভাবকদের অতিরঞ্জিত আলোচনাও আগুনে ঘি ঢালে।
ভ্যান্সের মন্তব্য
গুজব ছড়াতে শুরু করে গত ২৮ আগস্ট ইউএসএ টুডে-কে দেওয়া ভ্যান্সের একটি সাক্ষাৎকারের পর। গণমাধ্যমটির হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা ফ্রান্সেসকা চেম্বারস ভ্যান্সকে প্রশ্ন করেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শপথ নেওয়া সবচেয়ে প্রবীণ প্রেসিডেন্ট। এই প্রেক্ষাপটে তিনি কি সর্বাধিনায়ক হওয়ার জন্য প্রস্তুত?
জবাবে ভ্যান্স বলেন, আমি নিশ্চিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সুস্থ আছেন। তার মেয়াদের বাকি সময় পূর্ণ করবেন এবং আমেরিকান জনগণের জন্য অসাধারণ কাজ করবেন। আর যদি, ঈশ্বর না করুন, কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে, তবে গত ২০০ দিনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, এর চেয়ে ভালো প্রস্তুতি আর কিছু হতে পারে না।
যদিও ভ্যান্স একাধিকবার জোর দিয়ে বলেছেন যে ট্রাম্প সুস্থ আছেন, তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা ভ্যান্সের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কিত মন্তব্যকে ধরেই নেন- কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণের টুল রোলি আইকিউ- এর তথ্য অনুযায়ী, ২৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক্স, রেডিট, ইউটিউব ও ব্লুস্কাই প্ল্যাটফর্মে অন্তত ৫ হাজার ৬১৬ বার একটি বাক্য লেখা হয়েছে- ‘ট্রাম্প ইজ ডেড’। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের এক্স ব্যবহারকারীরাও একই বাক্য পোস্ট করেছেন। এই বাক্য ব্যবহার করে যেসব পোস্ট লেখা হয়েছে, এক্স-এ সেগুলো বেশ সাড়া ফেলেছে। প্রায় দুই মিলিয়নের বেশি লাইক এবং ১ লাখ ২২ হাজার শেয়ার হয়েছে।
ভ্যান্সের উক্তি নিয়ে তৈরি খবরও এক্স–এ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২৯ আগস্ট এক্স-এ একটি পোস্ট ১ কোটি ৩৮ লাখ বার দেখা হয়। যেখানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই সরাসরি বলা হয়, ‘ট্রাম্প মারা গেছে, তিনি গত বুধবার মারা গেছেন।’
ট্রাম্পের কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য নিয়ে গুজব
সামাজিক মাধ্যমের কিছু পোস্টে ট্রাম্পের দৈনন্দিন কর্মসূচিকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়। ২৬ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠক টেলিভিশনের সম্প্রচার হয়েছিল। কিন্তু এরপর টানা ছয়দিন ট্রাম্পকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। যিনি নিয়মিত টেলিভিশনের পর্দায় থাকেন, তাকে হঠাৎ আর টিভিতে দেখতে না পাওয়াটা গুজবকে আরও বেগবান করে।
২৯ আগস্ট অল-মনিটর নামের একটি গণমাধ্যমের কূটনৈতিক প্রতিবেদক লরা রোজেন পোস্ট দেন, ‘পুরো সপ্তাহে ট্রাম্পের কোনো কর্মসূচি নেই। আজও তাকে দেখা গেছে, এটি বিশ্বাস করবেন না।’ এই পোস্টটি ৩৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ভিউ হয়।
প্রকাশ্যে ট্রাম্পের কোনো কর্মসূচি না থাকলেও তিনি হোয়াইট হাউসে নিয়মিত কাজ করেছেন। তবে সামাজিক মাধ্যমের কিছু ব্যবহারকারী ট্রাম্পের ফোলা গোড়ালি ও চোটের চিহ্নযুক্ত হাতের ছবি পোস্ট করেন। গত সোমবার টিকটকে এক ব্যবহারকারী নিজেকে ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন। পাশাপাশি দাবি করেন, ‘প্রেসিডেন্ট স্ট্রোক করেছেন এবং হোয়াইট হাউস এ নিয়ে মিথ্যাচার করছে।’ ভিডিওটি তিন মিলিয়নেরও বেশি ভিউ হয়। যদিও পরে তা মুছে ফেলা হয়েছে।
সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম আইন ও নৈতিকতা বিষয়ের অধ্যাপক জেফ্রি ব্লেভিন্স বলেন, ভ্যান্সের মন্তব্য হয়তো সাধারণভাবেই করা হয়েছিল, তবে ফোলা চিহ্ন, ট্রাম্পের স্বাস্থ্যের প্রশ্ন এবং প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচি না থাকা; এসব কিছু মিলে ‘আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।’
ট্রাম্পই একমাত্র বিশ্বনেতা নন, যাকে মৃত্যু সংক্রান্ত গুজবের শিকার হতে হয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন স্কুলের অধ্যাপক ক্লিফ ল্যাম্পে বলেন, ১৯৪০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। স্ট্যালিন মারা যান ১৯৫৩ সালে।
ল্যাম্পে আরও জানান, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়েও মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল।
জল্পনা ছড়ান উদারপন্থীরা
উদারপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও বানান। তাদের এই ভিডিও জল্পনা ছড়াতে অবদান রেখেছে। এসব বিশ্লেষকরা তাদের ভিডিওতে ট্রাম্পের স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, হোয়াইট হাউস থেকে জবাবও চান। ভিডিওগুলোর ভিউ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।
আবার কিছু ইনফ্লুয়েন্সার (প্রভাবক) ট্রাম্পের ছবি শেয়ার করে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানান। তারা ভিডিওতে উল্লেখ করেন, ট্রাম্প বেঁচে আছেন। তিনি ভার্জিনিয়ায় গলফ খেলতে যাচ্ছেন।
অ্যারন পারনাস নামে এমনই একজন ইনফ্লুয়েন্সার বলেন, ট্রাম্পের মৃত্যুর বিষয়টি গুজব। তবে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন স্কুলের অধ্যাপক ক্লিফ ল্যাম্পে বলেন, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদায় ঘাটতি দেখা দিলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ায়। আবার যাকে পছন্দ করে না, তাকে নিয়েও নানা কথা বলে। বর্তমান প্রশাসনকে যারা পছন্দ করছে না, তাদের কাছে ষড়যন্ত্রসহ নানা তত্ত্ব, জমে থাকা চাপ প্রশমনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।