এপ্রিল ১০, ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
photo: collected
গত এক সপ্তাহ ধরেই নিজেই তৈরি করা অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প তার শুল্ক নীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের পরামর্শ উপেক্ষা করে আসছিলেন। শেয়ারবাজার ধস, বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পর বদলাতে হলো সিদ্ধান্ত।
মঙ্গলবার রিপাবলিকানদের এক বৈঠকে ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমি জানি আমি কী করছি।”
অথচ তার আরোপিত বিশাল শুল্কের চাপেই বিশ্ববাজারে ধস নামে।
বুধবার সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, “COOL থাকুন! সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি তাকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করে।
বিশেষ করে সরকারি বন্ডের সুদের হার দ্রুত বেড়ে যাওয়ার পর বুধবার বিকেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, আগামী ৯০ দিনের জন্য তার আরোপিত পাল্টা শুল্ক স্থগিত থাকবে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত চারজন কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মনে করি মানুষ একটু বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তারা একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল, একটু বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিল।”
হোয়াইট হাউসের খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা আশঙ্কা করেছিলেন অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ট্রাম্পকে পরামর্শ দেন, যেন তিনি চীনকে মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে রেখে আরও কাঠামোবদ্ধ কৌশল নেন। পাশাপাশি বাজারে আস্থা ফেরাতে বাণিজ্য বৈষম্য মোকাবেলায় ট্রাম্পের দৃঢ় অবস্থানের বার্তা দিতে বলা হয়।
তবে হঠাৎ এই শুল্ক স্থগিতের সিদ্ধান্তের পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের টিম প্রচার করতে শুরু করে, এটি ছিল ট্রাম্পের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ — তার বিখ্যাত বই “দ্য আর্ট অব দ্য ডিল”-এর মতোই কৌশলী পদক্ষেপ।
তবে অবশেষে নিজেই স্বীকার করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প — বাজারের চাপই তাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করেছে।
তিনি বলেন, “আমি মূলত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কাজ করেছি।”
এমনকি ট্রাম্পের শীর্ষ কর্মকর্তারাও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার এই খবর পান তখনই, যখন তিনি কংগ্রেসের এক কমিটির সামনে পুরনো শুল্কের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী বেসেন্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে শুল্ক স্থগিতের সিদ্ধান্তে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তবে ট্রাম্পের উপদেষ্টারা ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন, আসল কৃতিত্বের দাবিদার আসলে বন্ড বাজার।
কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান কারণ ছিল ভয় — তার শুল্ক নীতির কারণে দ্রুতই একটি আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল।
আর গত ২০ বছরে ঘটে যাওয়া আগের দুইটি বড় ধস — ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০২০ সালের মহামারিজনিত সংকটের মতো এই সংকটের জন্য কোনও বাহ্যিক কারণ থাকত না।
বরং এই সংকটের পুরো দায়ভার চাপত একজন ব্যক্তির ওপর — ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপরই।
শেষ মূহুর্তে নাটকীয় পরবির্তন!
বুধবার সকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকানদের শেয়ার কিনতে উৎসাহিত করেন এবং বিভিন্ন কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ ও ব্যবসা স্থানান্তরের আহ্বান জানান।
তবে তখনও পরিষ্কার ছিল না যে কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি হঠাৎ করেই মত বদলে অনেক শুল্কের ওপর ৯০ দিনের জন্য স্থগিতাদেশ দেবেন।
এই ঘোষণা আসার পরই বিশ্ববাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে — ট্রাম্পের শেয়ার কেনার পরামর্শ কি আসলে বাজারের বড় উল্লম্ফনের ইঙ্গিত ছিল, যা কিছু বিনিয়োগকারী সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন?
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার কিছুক্ষণ পরই ট্রাম্প ওভাল অফিসে বৈঠকে বসেন বেসেন্ট, লুটনিক এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের পরিচালক কেভিন হ্যাসেটের সঙ্গে।
তারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডের সুদের হার নিয়ে আলোচনা করেন এবং মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থার সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিশেষ করে, সুদ বাড়ার ফলে ব্যাংকিং খাতে এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানে কী প্রভাব পড়বে — ট্রাম্প সেটি খুব ভালোভাবে বোঝেন, কারণ রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে আসা তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার ফলে মার্কিন সরকারি বন্ড এবং ডলারের বাজারে ব্যাপক বিক্রির চাপ তৈরি হয়েছিল। সাধারণত এই ধরনের সম্পদকে বিনিয়োগকারীরা সংকটের সময় নিরাপদ আশ্রয় মনে করেন।
ট্রাম্প নতুন শুল্কের ঘোষণা দেওয়ার পর ওয়ালস্ট্রিটের অর্থনীতিবিদরা দ্রুত মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস বাড়িয়ে দেন এবং প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দেন। অনেকে মন্দার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই শেয়ারবাজার থেকে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ উধাও হয়ে যায়।
বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন — তিনি ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত রাখবেন, তবে চীনের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করবেন।
এই ঘোষণা ছিল গত কয়েকদিন ধরে ট্রাম্পকে বিভিন্ন মহল থেকে দেয়া পরামর্শেরই একটি সংস্করণ। অধিকাংশ দেশের জন্য ১০ শতাংশ শুল্ক রেখে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বেসেন্ট ও হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি লেভিট।
তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন — এটি আসলে একটি পূর্বপরিকল্পিত কৌশলেরই অংশ, যার লক্ষ্য ছিল আমেরিকান শ্রমিকদের ক্ষতির জন্য চীনকে এককভাবে দায়ী করা।
বেসেন্ট বলেন, “এটাই শুরু থেকেই ছিল তাঁর (ট্রাম্পের) কৌশল।”
লেভিট দাবি করেন, এটি ছিল কৌশলী দর-কষাকষির নিদর্শন।
তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা হয়তো ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ পড়েননি। আপনারা ধরতেই পারেননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করছেন। আপনারা ভেবেছিলেন, বাকি বিশ্ব চীনের দিকে ঝুঁকবে। অথচ বাস্তবে আমরা উল্টো প্রভাব দেখেছি। এখন সারা বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাচ্ছে। কারণ তারা আমাদের বাজার, আমাদের ভোক্তা এবং এই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ চায়। এ কারণেই ৭৫টির বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।”
ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লেখেন, “আপনারা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কৌশল প্রত্যক্ষ করছেন, যা কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করেছেন।”
বেসেন্ট দাবি করেন, ৯০ দিনের শুল্ক স্থগিতের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের নিজস্ব ভাবনা থেকেই এসেছে।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের পেছনে শেয়ারবাজার থেকে ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।
তিনি আরও বলেন, “এই বিষয়ে আমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই। আজকে আমাদের ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের নিলামও ভালো হয়েছে।”
তবে তিনি স্বীকার করেন, ট্রাম্প প্রশাসন নানা দেশের সঙ্গে আলোচনার অনুরোধ পাচ্ছিল, আর প্রতিটি আলোচনা আলাদা হবে এবং সময়সাপেক্ষ হবে বলেই শুল্ক স্থগিত রাখা হয়েছে।
ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসন মুহাম্মদ ইউনূসও চিঠি পাঠিয়েছেন ট্রাম্পকে এবং ট্রাম্পের এই নতুন ঘোষণায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইউনূস।