এপ্রিল ৮, ২০২৫, ০৭:১৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিবিশিষ্ট দেশগুলোর ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ঋণমানের অবনতি, ঋণপ্রবাহে স্থবিরতা এবং আর্থিক খাতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এই চাপ বেশি পড়বে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংক খাত ও অর্থনীতিকে চাঙা করতে নীতিনির্ধারকদের আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। খবর আজকের পত্রিকা।
২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অধিকাংশ বাণিজ্য অংশীদারের জন্য আমদানি শুল্কে ব্যাপক বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। মুডিসের গতকাল (৭ এপ্রিল) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে (এপিএসি) এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব ব্যাংকগুলোর জন্য নেতিবাচক, যদিও ক্ষতির মাত্রা দেশভেদে ভিন্ন। এতে বিনিয়োগকারী ও ভোক্তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়বে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের অর্থনীতি আমেরিকান রপ্তানির ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় এ তিন দেশের ব্যাংক সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হবে। এই দেশগুলোর যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে, যার প্রভাব ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি ও গুণগত মানের ওপর পড়বে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে আরোপিত উচ্চ শুল্কের ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাত ভারতের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ও শ্রমিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রায় ২০ শতাংশ ব্যাংকের ঋণের ওপর দাঁড়ানো আরএমজি ও সংশ্লিষ্ট খাত এখন ঝুঁকিতে রয়েছে।
মুডিস জানিয়েছে, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কহার অত্যন্ত বেশি। এর মধ্যে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের অনুপাতে রপ্তানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অধিক নির্ভরশীল। ফলে এই দুই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা লাগবে এবং এর প্রভাব ব্যাংক খাতে গিয়ে পড়বে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
এমনিতেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের পরিবেশ দুর্বল। এর ওপর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চলমান অর্থনৈতিক মন্থরতা আরও প্রকট হবে, যা ব্যাংক খাতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্য দেশগুলো যেমন চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানে শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম হবে। এর পেছনে দুটি কারণ—অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কম নির্ভরশীলতা। তবে কিছু কিছু খাত প্রভাবিত হতে পারে।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপাইনের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বৃদ্ধির মাত্রা কম হওয়ায় এসব দেশের ব্যাংক তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্কহার বর্তমানে ৫৪ শতাংশ হলেও দেশটির জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি থেকে আসে। ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও করপোরেট ঋণ সক্ষমতায় এর প্রভাব সীমিত হবে। অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ও ব্যবসায়িক আস্থা বৃদ্ধির জন্য চীন সরকার নীতিগত সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা যায়।
মুডিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, উচ্চ শুল্কের চাপ সামলাতে কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়তো আগেভাগেই সুদের হার কমানো শুরু করবে, অথবা সুদের হার বাড়ানোর গতি কমাবে; যেমনটি জাপানে দেখা যাচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে ব্যাংকের মার্জিন কমে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আমরা আশা করি, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার হ্রাস, ঋণ পুনর্গঠনসহ আরও সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে প্রধান ক্ষতি হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমইএস) খাতে। কারণ, এই খাত দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সক্ষমতা রাখে না।
অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠানই বিশ্বখ্যাত ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলোর সরবরাহকারী, যারা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রয় হ্রাসের মুখে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ব্যাংকগুলোতে এসএমই ঋণের অনুপাত প্রায় ২০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এ হার ১০ শতাংশের নিচে। তবে থাইল্যান্ডের ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, সেখানে এসএমই ঋণের গুণগত মান বহুদিন ধরেই দুর্বল।