ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ ঘোষিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি শেষ হয়েছে।
শনিবার, ১২ এপ্রিল বিকেল ৩টার কিছুক্ষণ পরে এই কর্মসূচি শুরু হয়। বিকেল ৪টার দিকে ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে এই কর্মসূচি শেষ হয়। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও বক্তব্য দেন।
এর আগে আজ সকাল থেকেই রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। মিছিলে অংশ নেওয়া অধিকাংশের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা ও বিভিন্ন স্লোগানসম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে।
ফেসবুকে ‘মার্চ ফর গাজা’ নামে একটি ইভেন্ট পেজ তৈরি করেছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ। কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল, আলেম-ওলামা সমাজসহ সব অঙ্গনের মানুষ সংহতি জানিয়েছেন। ফলে সকাল থেকে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে লোকারণ্য হয়ে ওঠে উদ্যান।
ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কিছু দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো—ইসরায়েলি গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে; যুদ্ধবিরতি নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে; পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
মুসলিম নেতাদের প্রতি যেসব দাবি জানানো হয়, সেগুলো হলো—ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে; জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে; গাজার মজলুম জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে এবং জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়—বাংলাদেশি পাসপোর্টে `Except Israel` শর্ত পুনর্বহাল করতে হবে এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে; সরকারের ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে; রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে; সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে; জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে, যেহেতু হিন্দুত্ববাদ আজ শুধু একটি স্থানীয় মতবাদ নয়—বরং আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট ব্লকের অন্যতম দোসর এবং পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ মুসলিম প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় নিয়ে গড়ে ওঠে।
সবশেষে ঘোষণাপত্রে থেকে কিছু অঙ্গীকার করা হয়। সেগুলো হলো—আমরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করব সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে; আমরা আমাদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করব, যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সব প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে; আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো—যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্ৰস্তুত থাকবে এবং আমরা বিভাজিত হবো না, কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না।
সোহরাওয়াদী উদ্যানের আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উদ্যানের রমনা কালিমন্দির গেট, টিএসসি সংলগ্ন গেট, রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেট, ভিআইপি গেট দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই মিছিলসহ সমাবেশস্থলে আসছেন অংশগ্রহণকারীরা।
এ সময় ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’, ‘গাজা রক্তে রঞ্জিত, বিশ্ব কেন নীরব’, ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’ স্লোগান দিতে থাকেন কর্মসূচিতে আসা লোকজন।
বেলা ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, মৎসভবন, হাইকোর্টের সামনের এলাকা, ঢাবির কার্জন হল, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এলাকা, শাহবাগ, কাটাবন, বাংলামোটর লোকে লোকরণ্য হতে দেখা যায়। এসব এলাকাগুলো দিয়ে কোনো যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। বন্ধ ছিল রিকশাও।
এদিকে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পানির ট্যাংক দেখা গেছে। মার্চ ফর গাজা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া লোকজনদের পানি খাওয়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন ট্রাফিক পয়েন্টগুলোতে কোনো পুলিশ দেখা যায়নি। তবে লোকে লোকারণ্য হওয়ায় ট্রাফিক ব্যবস্থা অকেজো হয়ে গেছে বলে জানায় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।
দুপুরের দিকে উদ্যান ও এর আশেপাশের এলাকা পূর্ণ হয়ে গেলে মূল মঞ্চ থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভরে গেছে, আপনারা যে যেখানে আছেন, সেখানে বসে পড়ুন।’ এরপর থেকে মিছিল উদ্যানের দিকে আসা বন্ধ হয়।
দুপুর আড়াইটার দিকে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট মোড়, আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড, বুয়েট এলাকা, চানখারপুল, গুলিস্তান, বায়তুল মোকারমের চারপাশ, জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন এলাকা, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, ফার্মগেট, কাওরান বাজার মোড়, বাংলামোটর, সায়েন্স ল্যাব, কাঁটাবন মোড় এলাকায় মানুষের ভিড় দেখা যায়। এসব এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের ডিসি মো. শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মার্চ ফর গাজা কর্মসূচি ঘিরে ঢাকার ট্রাফিকব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে আশেপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোনো যানবাহন চলছে না।
তিনি বলেন, সকালের দিকে আমরা বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচলের পরামর্শ দেই। পরে বিকল্প সড়কও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা যেন থমকে যায়।
ডিসি মো. শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা এখন ভাবছি, কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলে এসব মানুষ কিভাবে যাবে, তা নিয়ে ভাবছি।
এদিকে মগবাজার এলাকায় দেখা যায়, মানুষের চাপে রামপুরা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মৌচাক থেকে শান্তিনগর ফ্লাইওভার দিয়েও আসছে নারী, পুরুষ, শিশু বৃদ্ধসহ সববয়সী মানুষ। এর ফলে ফ্লাইওভার দিয়েও যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে জমায়েত ঘিরে উদ্যানের আশপাশে জমে উঠেছে ফিলিস্তিনের পতাকা, মাথার ব্যাজ ও টি-শার্ট বিক্রি। আর আগ্রহ নিয়েই সেসব কিনছেন আগত অনেকেই।