ফসল উৎসর্গ করে দেবতা তুষ্টি

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

অক্টোবর ২২, ২০২৩, ০৮:৩০ পিএম

ফসল উৎসর্গ করে দেবতা তুষ্টি

বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল এন্ড কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল গারোদের এই ওয়ানগালা উৎসব।

প্রতি বছর হেমন্তে শস্য দেবতাকে সম্মান জানিয়ে গারো সম্প্রদায় উদযাপন করে ওয়ানগালা উৎসব। আদিবাসী গারোদের বিশ্বাস, শস্য দেবতা বা ‘মিশি সালজং’ পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারা বছর পরিমাণমতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভালো শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। 

গারোদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। এ উৎসবকে তারা বলে– ওয়ান্না, ওয়ানাগালা, ওয়ানমা রংচুয়া ও দ্রুয়া ওয়ানবলা। 

সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ-উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে গারোদের নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকে। 

‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। এটি গারোদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। উৎসর্গপর্বটি ধর্মীয় দিক আর ভোজ, নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও সম্মিলনের দিকটি সামাজিক দিক। 

তবে গারোদের কাছে ওয়ানগালার মূল বিষয়টি ধর্মীয়। পূজা-অর্চনার মাধ্যমে দেব-দেবীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও নানা আবেদন-নিবেদন করা হয় এ-উৎসবে। এ-কারণে অনেকেই এটিকে নবান্ন ও ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকে। দেবতা মিশি সালজংকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এই উৎসবের প্রচলন। 

গারো সমাজে কথিত আছে, দেবতা মিসি সালজংয়ের একবার ছোটভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ফলে তিনি ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। তার সংসারে তখন অভাব চলছিল। স্ত্রীর মুখে বড়ভাই আসার খবর শুনেও তিনি ঘরের বাইরে এলেন না, বরং বিরক্ত হলেন। স্ত্রী বলেন, ‘অতিথিকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করব?’

উত্তরে ছোটভাই বলেন, ‘একটি পাত্রে কিছু ঘুঁটে নিয়ে পুড়িয়ে দাও। সে তার ঘ্রাণ নিক।’

ভাইয়ের ব্যবহারে মিসি সালজং অপমানিত ও রাগান্বিত হন। অতঃপর তিনি চলে আসেন পৃথিবীতে। যে-স্থানে তিনি আবির্ভূত হন, সেখানে থাকতেন এক বিধবা। নাম ‘আইসেগ্রির মিসালি সিংসালি টোটমারি কিংমারি’। বিধবা খুবই গরিব ছিলেন। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে থাকতেন শুকনো লতাপাতার ছাউনি দেওয়া ছোট্ট কুঁঁড়েঘরে। ঘরের চারপাশ ছিল জংলি পাতার ঘের দেওয়া। তাদের খাবার জুটত না ঠিকমতো। গরিব হলেও তারা ছিল খুবই সহজ-সরল। মনটা ছিল উদার।

মা-মেয়ে মিলে তখন পাহাড়ি শাক রান্না করে খাচ্ছিল। এমন সময় দেবতা মিসি সালজং সেখানে উপস্থিত হলেন। তাকে তারা চিনতে পারল না। রাগ ও বিরক্তও হলো না। তিনি তাদের বললেন, ‘আমি আজ তোমাদের বাড়িতে থাকব।’

আইসেগ্রি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বলল, ‘আমি এক দুঃখী বিধবা নারী। শুকনা কলাপাতার ছাউনি ও বুনো লতাপাতার বেড়া দেওয়া ঘরে কোনোরকমে থাকছি। এ-ঘর আপনার মতো সম্মানীয় অতিথির থাকার যোগ্য নয়।’

মিসি সালজং তার সরলতায় মুগ্ধ হলেন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু গনগাজা ডিল ও রিসিম গাছের কষ সংগ্রহ করে গাছের গুঁড়া দিয়ে পুড়িয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ধূপের সুগন্ধি আমার জন্য দিও।’

তারা মিসি সালজংকে ঘরে থাকতে দিল এবং পরামর্শমতো ধূপ-সুগন্ধি উৎসর্গ করল। এতে তিনি খুশি হলেন। পরদিন পাহাড়ে হয় এমন ধানের বীজ বিধবার হাতে তুলে দিয়ে মিসি সালজং বললেন, ‘প্রতিবছর এ-সময়ে এভাবেই আমি আসব। তখন তোমরা আমার জন্য ধূপ-ধুনা পুড়িয়ে সুগন্ধি উৎসর্গ করবে। আনন্দ-ফুর্তি করবে, খাওয়া-দাওয়া করবে।’

গারোদের বিশ্বাস, সেই দিন থেকেই প্রতিবছর ফসল তোলার পর ধূপ জ্বালিয়ে পানাহার করে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে তারা ‘ওয়ানগালা’ উৎসব পালন করে আসছে।

গারোরা ওয়ানগালা উৎসবের প্রথম দিনকে ‘রুগালা’, দ্বিতীয় দিনকে ‘সাসাত স’আ’ ও তৃতীয় দিনটিকে বলে ‘ক্রাম গগাতা’।

ওয়ানগালা উৎসবের নিয়ম অনুসারে জুম ক্ষেতের মাঝখানের কিছু অংশের ধান কাটা হয় সবশেষে। ওই স্থানটিকে গারোরা বলে আ’সিরকার স্থান। ধান কাটা হয় দেবতার উদ্দেশে ধূপ উৎসর্গ করে। অতঃপর গোড়া থেকে কেটে আঁটি বেঁধে এরা ধান নিয়ে আসে বাড়িতে। এ-সময় সবাই মিলে আনন্দধ্বনি করে। এদের বিশ্বাস, শেষ ফসলের সঙ্গে তারা ক্ষেতের দেবতাদেরও এভাবে বাড়িতে নিয়ে আসে। তারা মনে করে, দেব-দেবীগণ পৃথিবীতে সবসময় থাকে না। ওয়ানগালার সময় তাঁরা ভক্তদের আশীর্বাদ করে চলে যায় নিজ আবাসে।

ধান ঘরে এনে প্রথমে এরা মোরগ উৎসর্গ করে মিসি সালজং বা সূর্যদেবতার নামে। কারণ সূর্যদেবতার নামেই ওই স্থানে ধান রোপণ করা হয়েছিল। অতঃপর নতুন ধানের চাল দিয়ে এরা ওয়ানগালার জন্য মদ তৈরি করে। এ-অনুষ্ঠানের পর সংনি নকমা (গ্রামপ্রধান) সবাইকে ডেকে সভা করে ওয়ানগালা উৎসবের দিন নির্ধারণ করেন। দিনের সংখ্যা অনুসারে সমতলের গারোরা একটি রশিতে আর পাহাড়ের গারোরা ওমাক বিগিল নামে এক প্রকার গাছের ছাল দিয়ে গিঁট বেঁধে তা ঘরের চালে বেঁধে রাখে। একদিন পার হলেই এরা একটি করে গিঁট খুলে দেয়।

ওয়ানগালার আগে গারোদের কলার পাতা ছিঁড়ে ব্যবহার করা নিষেধ থাকে। উৎসবের দিন ঘনিয়ে আসার আগেই গ্রামগুলোতে মদ তৈরির ধুম পড়ে যায়। সবাই পূজার স্থান, বাড়িঘর ও গোলাঘর মেরামত ও পরিষ্কার করে। উৎসবের জন্য বাজার থেকে কিনে আনা হয় গরু, শূকর, ছাগল, মোরগ। বাড়ির লোকদের জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক ও অলংকারাদি। উৎসবে ব্যবহারের জন্য জোগাড় করা হয় মোরগ ও ডুকুয়া পাখির পালক।

শুধু তাই নয় ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষে বসে ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং পোশাকের মেলা। জীবন্ত কচ্ছপ, কুচিয়া কেনাবেচা হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন নবীন-প্রবীণরা। সবার ইচ্ছে এবছরের উৎপাদিত ফসলের পূজোয় দেবতা খুশি হবেন এবং পরবর্তী বছর যেন ঠিকভাবে ফসল ফলাতে পারেন সেই প্রার্থনাই করবেন তারা। 

তবে কালের বিবর্তনে ইট কাঠের শহরে এটি শুধু দিনব্যাপী একটি উৎসবই নয় বরং গারো নৃগোষ্ঠীর মিলনমেলা হয়ে গেছে। তেমনই এক মিলনমেলা আয়োজিত হল গতকাল (২১ অক্টোবর)। বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল এন্ড কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল গারোদের এই ওয়ানগালা উৎসব। 

মেলায় ঘুরতে আসা কয়েকজন তরুণ বলেন, এটা এখন আর উৎসব নয় বরং নিজেদের গোত্রের লোকেদের সঙ্গে দেখাশোনা হবার একটা মাধ্যম। বছর পর অনেক আত্মীয়দের সাথে দেখা হয় তাদের। যেটা শহুরে ব্যস্ততায় সম্ভব হয় না। তবে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই ওয়ানগালা উৎসবে সবাই নিজেদের দূরত্ব ঘুচিয়ে একে অপরের সংস্পর্শে আসেন।

উৎসবে হাজারো বছরের সাংস্কৃতিক পরম্পরায় নাচে ও গানে দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন গারো সম্প্রদায়ের তরুণ শিল্পীরা। রঙ বাহারি পোশাক আর মাথায় মুরগির পাখনা দিয়ে নিজস্ব ভাষার গানে মেতেছিলেন গারো অধিবাসীগণ। তবে দর্শন হিসেবে শুধু গারোই নয় বরং বাঙালিরাও ছিলেন ওয়ানগালা এই মেলায়। 

Link copied!