গত সপ্তাহে দেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে একটি খবর প্রচারিত হয়। খবরটি এ রকম, কক্সবাজারে এক নারী তাঁর কন্যাশিশুকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে আরেকজন দম্পতির সদ্যজাত ছেলেসন্তান নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে কিশোরগঞ্জ থেকে শিশুসহ সেই নারী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ ঘটনার পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই নারীকে। নারী জানান, এর আগে তাঁর তিনটি কন্যাশিশু হয়েছে। স্বামী ছেলেসন্তান চায়। তাই স্বামীর চাওয়া পূরণ করতেই নিজের সদ্যজাত কন্যাশিশুকে বিক্রি করে ছেলেশিশু চুরি করেন।
এ রকম ছেলেসন্তানের জন্য নবজাতক চুরির আরও বহু ঘটনা অতীতে ঘটেছে। চুরি যাওয়া শিশুদের অনেকে মায়ের বুকে ফিরতে পারে। অনেকের আর ফেরা হয় না। এসব ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। ফলে সহজেই বোঝা যায় ছেলে সন্তানের জন্য আমাদের হাহাকার কত বেশি! এই চিন্তা কত গভীর হয়ে আমাদের সমাজে গেড়ে বসেছে। এ থেকে যেন মুক্তি নেই।
বাবা-মায়ের দায়িত্ব কি শুধু ছেলের?
আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছেলে সন্তান চায়। মেয়ে সন্তান অনাকাঙ্খিত। কারণ পুরুষ মানেই পরিবার ও সমাজের কর্তা। আর পুরুষের কর্তৃত্ব, প্রভুত্বকে মান্য করে নারী। সামাজিক রীতি অনুসারে, মেয়ে বিয়ে করে অন্য একটি পরিবারে চলে যায়। সমাজের সকল অসঙ্গতি মেনে নিয়ে সংসার করে। আর ছেলে সন্তান পরিবারের হাল ধরে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়। বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখে। এই ধরনের চিন্তার ভিত্তিতেই সমাজে নারী, পুরুষের অবস্থান।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে আসলেই কি মেয়েরা পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়টি দেখভাল করতে পারে না? বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে পারে না? নাকি তাদের এসব করতে দেওয়া হয় না?
যুগ যুগ ধরে সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা বিদ্যমান। কর্তৃত্ব যেন পুরুষের হাতে থাকে এজন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে নারীকে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারে ছেলে সন্তানকে বেশি সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়ে বড় করা হয়। আর মেয়ের ক্ষেত্রে থাকে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। কারণ ছেলে সন্তান ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নেবে, এই ভাবনা থেকে ছেলের আবদারগুলো ইতিবাচকভাবে দেখা হয়।
বেশিরভাগ বাবা-মা ছেলের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বলেন, ‘তোমাকে পারতে হবে বা তুমি পারবে।’ অন্যদিকে মেয়েকে বলেন, ‘সহ্য করো, মেনে নাও’। পরিবারে ছেলেদের মতামতের অনেক দাম। অনেক সময় পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মায়ের চেয়ে ছেলের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। এভাবে ছোটবেলা থেকে ছেলে পরিবারে নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে। আর মেয়ে বড় হয় অবদমিত মন নিয়ে।
কন্যাসন্তান জন্ম নিলে
অনেকের মতে, এখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। কিছু পরিবার এখন ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য করে না। তবুও বেশিরভাগ মানুষ এখনও ছেলে সন্তান হলেই বেশি খুশি হয়। মেয়ে সন্তানকে হয়ত সরাসরি অবহেলা করেন না লোকলজ্জায়। তখন তারা ছেলে হলে খুশি হয় কিন্তু মেয়ে হলে মেনে নেয়।
দেখবেন, প্রথম সন্তান কন্যা হলে আত্মীয়-পরিজনরা বলবে- ‘আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নাও। এবার ছেলে হবে।’ কিংবা অনেকে বলে, ‘আহারে, প্রথম সন্তান ছেলে হলে ভালো হত।’
অনেকেই মনে করেন, বাবার কাজ কিংবা ব্যবসা দেখার জন্য ছেলে দরকার। মেয়েরা এসব পারে না। এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। মেয়ে হয়েও বাবার উত্তরসূরী হয়েছেন তিনি।
মেয়েদের শক্তি কম?
আরেকটি কথা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ মনে করেন, ‘মেয়েদের শক্তি কম’। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে সামাজিক দায় আছে। একটু বড় হলেই এদেশের অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের খেলাধুলা করতে দেওয়া হয় না। ভাল খাবারগুলো চলে যায় পুত্র সন্তানের পাতে। তাই মেয়েদের শারীরিক বিকাশও হয় না ঠিকমত। ফলে খুব কম মেয়েই সুঠাম দেহের অধিকারী হতে পারে। তবে উন্নত দেশে মেয়েরা অনেক খেলাধুলা ও শারীরিক পরিশ্রম করে। তাই তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয় না। ফলে শক্তিতে মেয়েরা পিছিয়ে তা বলা যাবে না। আমাদের দেশের নারী ক্রিকেটারদের সাফল্যই প্রচলিত এই ভুল ভাঙানোর জন্য যথেষ্ট।
ধর্মে সম্পদের ভাগ
মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক সম্পত্তি পায়। আর হিন্দুধর্মে মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পায় না। তাই যে বাবার ছেলে সন্তান নেই তার সম্পত্তি ভাইয়ের ছেলে অর্থাৎ ভাতিজা পায়। এজন্য হিন্দুধর্মে অনেক নারীকে ছেলে সন্তান না হওয়া পর্যন্ত সন্তান নিতে বাধ্য করা হয়। সুতরাং দুটো ধর্মেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলেকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সবক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে সমাজে নারীর অবস্থান অনেক নিচে, তাই নারী সন্তানও অনাকাঙ্খিত।
মেধায় পিছিয়ে নেই মেয়েরা
মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা যেখানে নারী ও পুরুষ এখন পাল্লা দিয়ে চলছে, সেই যুগেও বাবা-মায়েদের ছেলেসন্তানের জন্য এভাবে হাহাকার করতে দেখলে সত্যিই কষ্ট লাগে। মানসিকতা কি আর তাহলে পাল্টাবে না? সব ছেলেসন্তানই কি ভালো হয়? সব ছেলে কি তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল? সব ছেলেই কি বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে দেখে? মেয়েসন্তানরা কি তাদের বাবা-মাকে দেখে না? নিজেদের চারপাশে তাকালে তো এ রকম উদাহরণ কম দেখা যাবে না। তাহলে কীসের এত ভাবনা?
ছেলে জন্ম না দেওয়ায় অতীতে অনেক নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। অনেক মেয়েকে তাঁদের স্বামীরা তালাক দিয়েছেন। অনেক মেয়ে সতীনের সংসার করছেন। এমনকি অনেকে খুনও হয়েছেন।
দায়ী নয় নারী
ছেলের সেক্স ক্রোমেজোম X, Y আর মেয়ের X, X। সুতরাং মেয়ের মধ্যে একই ধরনের ক্রোমোজোম থাকে। স্বামীর X ক্রোমোজোম স্ত্রীর কাছে আসলে মেয়ে হয় আর Y ক্রোমোজোম আসলে ছেলে হয়। ফলে সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তার জন্য কোনোভাবেই নারীরা দায়ী নন।
শেষ কথা
আমাদের সমাজ কন্যাশিশুদের বোঝা মনে করে। কন্যাশিশুদের পড়াশোনার পেছনে টাকা খরচ করতে চায় না। তারা মনে করে, বিয়ে দিতে পারলে বোঝা দূর হয়ে গেল। তবে সময় অনেক বদলেছে। কন্যাশিশুরা এখন আর বোঝা নয়, বরং তারা হলো সর্বোত্তম বিনিয়োগ ও সমাজের আলোকবর্তিকা। কারণ, তাদের মধ্য থেকেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুঁজে পাই।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই মা–বাবার বেশি যত্ন নেয়। আসলে কন্যাশিশুদের সুশিক্ষিত করার জন্য যদি ভালো বিনিয়োগ করা যায়, তবে সে একদিন বড় হয়ে আদর্শ ও মহীয়সী মায়ে পরিণত হয়। গাছকে যেমন ভালো পরিচর্যা করলে বড় হয়ে ফুল, ফল, কাঠ, ছায়া ও নির্মল পরিবেশ উপহার দেয়। ঠিক তেমনভাবে একটি কন্যাশিশুর পেছনে বিনিয়োগ করলে পরিণত বয়সে সে একজন আলোকিত মায়ে পরিণত হয় এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নানাভাবে আলোকিত করে।