ডিসেম্বর-১৬: বাঙালির বিজয়, ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ০৬:০৪ এএম

ডিসেম্বর-১৬: বাঙালির বিজয়, ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম

আজ ১৬ই ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে পৃথিবীর বুকে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

এদিন সূর্য প্রায় ডুবি-ডুবি। পূর্ব বাংলার যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর ঢাকা তখন থমথমে। শহরের আশেপাশে কোথাও থেমে-থেমে যুদ্ধও চলছিল, এমনকি শহরের প্রাণকেন্দ্রেও চলছিল বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ। এমন পরিবেশের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫টা ২৫ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি।

এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা শহরের পথে-পথে আকাশে রাইফেলের ফাঁকা গুলিতে প্রকম্পিত করে স্লোগান তোলেন—‘জয় বাংলা’। সন্ধ্যার পর থেকেই থমথমে ঢাকা তখন বিজয় উৎসবের নগরী। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিবাদে বেরিয়ে আসে পথে। রাতভর আলো জ্বলে নির্ঘুম ঢাকা নগরীর ঘরে-ঘরে।

যৌথ বাহিনীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আত্মসমর্পণের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জে. জে এফ আর জেকব। ভারত থেকে যশোরে হেলিকপ্টার পরিবর্তন করে ঢাকা এয়ারফিল্ডে আসেন। সেখান থেকে তিনি, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী, কর্নেল এম এস খারা নিয়াজির হেডকোয়ার্টার্সের উদ্দেশে রওনা দেন। তারা দুপুর একটা নাগাদ পাকিস্তানি আর্মির হেডকোয়ার্টারে পৌঁছান। এরপর আত্মসমর্পণের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম গোছাতে শুরু করেন জেকব।

‘আমি নিয়াজির অফিসে ফিরে এলে কর্নেল খারা আত্মসমপর্ণের শর্তাবলি পাঠ করে শোনান। নিয়াজির চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা।’ জে এফ আর জেকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে  লিখেছেন এভাবেই।

পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র ও সেনা সমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী জনসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ করে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। এদিন, ৯০ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মুক্তি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।

দলিলে স্বাক্ষরের পর নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝোলানো রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলো তুলে দেন অরোরার হাতে।

১৯৭১ সালের এদিন মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, তাঁদের সরকার পরের সপ্তাহে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করবে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন বেসামরিক প্রশাসন চালু করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

একাত্তরের এদিন, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’

লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তি বাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।

নয় মাস দীর্ঘ একটা যুদ্ধ, যেখানে গোটা বিশ্বে একটি বড় আকারের নৃশংসতা, ১ কোটি মানুষের উদ্বাস্তুর দেশত্যাগ এবং ৩ কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুত প্রত্যক্ষ করেছিলো।– মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি বাঙ্গালী নারীরা।  এই যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হওয়ার পাশাপাশি ২লাখের বেশি নারী ধর্ষিত হওয়ার পরিসংখ্যান গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে। আর এসব ধর্ষিত বাঙালি নারীরা হাজারো যুদ্ধ শিশুর জন্ম দিয়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই-পুস্তক ও গবেষণা থেকে সংগৃহীত ঘটনাবলী নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের দর্শক ও পাঠকদের জন্য প্রতিবেদন সিরিজ ‘বিজয়ের দিনলিপি’ তৈরি করা হয়েছে।  দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের ইউটিউব চ্যানেলেও প্রতিবেদনটি ভিজুয়ালি দেখা যাবে। 

Link copied!