সবার চোখ ঢাকা সফররত দুই মার্কিন ‘বাজপাখি কূটনীতিকে’র দিকে

মিজানুর রহমান খান

জুলাই ১২, ২০২৩, ০৫:৪২ এএম

সবার চোখ ঢাকা সফররত দুই মার্কিন ‘বাজপাখি কূটনীতিকে’র দিকে

মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল এখন ঢাকায়। ওই দলে অন্যদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই কূটনীতিককে বলা হচ্ছে ‘বাজপাখি কূটনীতিক।’ কূটনীতিতে দুর্দান্ত সাফল্য আছে তাদের ঝুড়িতে। এই প্রতিনিধি দলে অন্যান্যের মধ্যে আছেন ইউএসএইড’র এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর। এর দুদিন আগেই ঢাকা সফরে আসেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। 

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে পশ্চিমা কূটনীতিকদের এই সফরের বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছে। তাদের সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণের কৌতুহলের শেষ নেই।

উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লু

দুজনই তুখোড় পেশাদার কূটনীতিক। ফরেন সার্ভিসে একজনের ক্যারিয়ার ২৭ বছরের, আরেকজনের ৩০। রাজনীতিতেও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভিন্ন সমাধান, গণতন্ত্র, মানবিক সহায়তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মেরামতে মার্কিন এ দুই কূটনীতিক কাজ করছেন। 
দাম্ভিক প্রকৃতির ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও উজরা জেয়া কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেন পেশাদারির সাথেই। দায়িত্ব পালনকালে স্বার্থ-সংঘাতের কারণ হিসেবে কখনই তার বংশপরিচয় ধরা পড়ে না। বরং মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বারবারই দিয়েছেন দক্ষ কূটনৈতিকের পরিচয়। ২৭ বছরের ফরেন সার্ভিসে উজরা জেয়া নয়াদিল্লিতে পলিটিক্যাল মিনিস্টারের দায়িত্ব সামলেছেন। প্যারিসেও ছিলেন ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে। সিরিয়া, মিসর, ওমান, জ্যামাইকাতেও পালন করেছেন দায়িত্ব।

২০২২ সালের শুরু থেকেই বারবার সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় তার নামই বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-সংক্রান্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রধান চালক হিসেবে মনে করা হয় তাকে। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে ডোনাল্ড লু রয়েছেন নেতৃত্বের আসনে।  

ফরেন সার্ভিস অফিসার হিসেবে ৩০ বছরেরও বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অধীনে কাজ করছেন লু। এর মধ্যে ১২ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন পাকিস্তান ও ভারতে। বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লু’র সফর তাই গুরুত্বের সাথে দেখছেন দেশের কূটনীতিকরা।

কেন মার্কিন ও ইইউ প্রতিনিধি দলের এই সফর?

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আগেই জানিয়ে দিয়েছে,  ঢাকা সফরকালে উজরা জেয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা করবে। আলোচনায় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, মানবাধিকার, শ্রম সম্পর্কিত বিষয়, মানব পাচার ও রোহিঙ্গা সংকটসহ বিভিন্ন দিক প্রাধান্য পাবে। এছাড়া,  মতপ্রকাশ ও সংগঠন গড়ার স্বাধীনতা, নারীর অধিকার, প্রান্তিক ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সম্পর্কেও মার্কিন প্রতিনিধিদলটি অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানা গেছে।

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় আসেন। সেলেরি রিকার্ডো এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়েনের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এরই মধ্যে ওই মিশন দলের ঢাকা সফরের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। প্রতিনিধি দলটি নির্বা্চন কমিশনের আমন্ত্রণে ১৫দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে আসছে ২৩ জুলাই ঢাকা ছেড়ে যাবেন। অনুসন্ধানী মিশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ নিবার্চন পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

দেশের কূটনৈতিক মহল কী বলছে?

মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরে আসার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের ‘সৃষ্ট সঙ্কট’ নিরসণ করার। যদিও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বোলছে, ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক হলেও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে কোনো পরামর্শ তারা দেয়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, মার্কিন ও ইইউ প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে একটা রাজনৈতিক সমঝোতার পথ বেরিয়ে আসতে পারে।

বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে গণতন্ত্রের সঠিক অনুশীলন দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তার জন্য সরকারের পরিকল্পনা ও বিরোধী দলগুলোর দাবির বিষয়গুলো জানতে তারা এসেছে। চাইলে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে তারা সহায়তা করবে বলে আগেই জানিয়েছে।  এমনকি জাতিসংঘও অবাধ নির্বাচনে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। তাই তাদের মতামতের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

একই সুরে কথা বলেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান। পেশাদার এই কূটনীতিক দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “ আমি মনে করি জাতীয় নির্বাচনের আগে হেভিওয়েট এই দুই প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরে সরকার ও বিরোধী দলগুলো অনেক বার্তা পাবে। আর এই বার্তায় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরদার করবে।”

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “মূলত এই দুই প্রতিনিধি দল ‘নির্বাচন নিয়ে ব্যবসা’য় মেতে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীতো আগেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় তিনি বলেছিলেন, গ্যাস দিতে চাইনি বলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েছে। এবারেও ওই ধরণের প্রস্তাব দেশের অন্যতম প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দিতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

দিল্লির ভূমিকা কী?

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত। আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধীদল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, আসছে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলটি ২৩ জুলাই ঢাকা ছেড়ে যাবে। আর তার আগেই ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়বে উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দলটি।

এই দুই প্রতিনিধি দলের ঢাকা ত্যাগের পর চলতি মাসের শেষের দিকে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল ভারত যাবে। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, বিজেপির সাথে বৈঠক আছে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলটির। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ওই বৈঠকের সাথে নির্বাচনের কোনো বিষয় নেই জানালেও দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে, ইইউ ও মার্কিন প্রতিনিধি দলের সাথে তাদের সাক্ষাতের বিষয়বস্তুগুলো আলোচনায় স্থান পেতে পারে। দিল্লিও ঢাকাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারে-এমন মন্তব্যও অনেক বিশ্লেষকদের। 

Link copied!