দাহ নাকি দাফন: ৯ বছর ধরে শেষকৃত্যের অপেক্ষায় হিমাগারে খোকন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ৬, ২০২৩, ০৯:১৮ পিএম

দাহ নাকি দাফন: ৯ বছর ধরে শেষকৃত্যের অপেক্ষায় হিমাগারে খোকন

চির ঘুমে আছেন খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী, তবে চিরশান্তিতে কি আছেন? কারণ, তিনি কোনো চিতা বা কবরে নয়, আছেন ঢাকা মেডিকেলের মর্গের ডিপ ফ্রিজে বন্দি। একদিন দুদিন নয়, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে। চিতা নাকি কবর, দাহ নাকি দাফন— দীর্ঘ এই ৯ বছরেও এর সুরাহা হয়নি। এর কারণ, খোকনের দুই স্ত্রী, একজন হিন্দু, একজন মুসলিম। দুই পক্ষই খোকনের মরদেহের শেষকৃত্য করতে চান নিজ নিজ ধর্মমতে। এ কারণে বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত।

বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও এর মীমাংসা হয়নি। ফলে হাইকোর্ট খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকা চৌধুরী ওরফে রাজীব চৌধুরীর মরদেহ হিমাগারেই রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সেই থেকে খোকন নন্দীর স্থান হয়েছে হিমাগারেই। কিন্তু এখন মরদেহের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান বললেন, দীর্ঘদিন একটি লাশ মর্গে থাকলে সেটি কিছুটা পরিবর্তন আসবে, এটাই স্বাভাবিক।

ঢামেক মর্গের ইনচার্জ সেকান্দার আলী জানান, দীর্ঘদিন লাশ মর্গে রাখা খুব কঠিন। লাশ শুকিয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ১৪ জুন খোকন চৌধুরী অসুস্থ হন। এরপর দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আকতার খানম ওরফে বাবলি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুন সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের সময় তিনি মারা যান। এরপর হাসপাতাল থেকে তাঁর সাথে থাকা দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আকতার খানম ওরফে বাবলি স্বামীর লাশ নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু খোকন চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী মিরা নন্দী এবং তাঁর দুই সন্তান বাবুল ও চন্দনা এতে বাধা দেন। তাঁরা দাবি করেন, তাদের বাবা খোকন নন্দীর লাশ তাঁরা নিয়ে হিন্দুধর্ম মতে সৎকার করবেন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর এই দুপক্ষের বিরোধের কারণে তৎকালীন রমনা থানা ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করে। তাঁরা না পারায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার সহকারী জজ আদালত (দেওয়ানি মামলা নম্বর ২৫২/১৪, ঢাকা) বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ও তদারকিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে খোকনের মরদেহটি সংরক্ষণের আদেশ দেয়। এরপর ৯ বছর  পেরিয়ে গেলেও মরদেহটি হিমঘরে পড়ে রয়েছে।

হাবিবা খানমের ভাষ্য, খোকন নন্দী মুসলমান হয়ে খোকন চৌধুীর নাম রেখেছিলেন। তাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই। এর আগে হাবিবুর রহমান নামে প্রথম শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে খোকন ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বিয়ের কাবিননামা, এফিডেভিট রয়েছে। খোকন চৌধুরী আমার স্বামী এবং মুসলমান— এটা প্রমাণের জন্য আর কী প্রয়োজন?

তিনি আরও জানান, খোকনের চার ভাইয়ের মধ্যে দুভাই জহরলাল নন্দী ও সাগর নন্দী রাজধানী ঢাকায় থাকতেন। তখন খোকন ও বাবলি উত্তর শাহজাহানপুরের ৩৩১ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। সেখানে খোকন চৌধুরীর ভাই সাগর নন্দী প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। আর সাগর নন্দী দীর্ঘদিন তেজতুরি বাজারে থাকতেন।

ফার্মগেটে খোকন চৌধুরীর মার্কেটের সামনে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, খোকন চৌধুরী আগে হিন্দু ধর্মের ছিলেন। কিন্তু পরে তাঁর চালচলনে মুসলমান হিসেবেই মনে হতো। আর অনেকেই তাকে খোকা ভাই বলে ডাকতেন। তিনি সকালে শাজাহানপুরের বাসা থেকে বের হতেন, আর রাতে বাসায় ফিরতেন। এ জন্য আশপাশের লোকজনের সাথে তাঁর তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তবে মাঝে মাঝে শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে স্থানীয় মসজিদে যেতেন খোকন। এ ছাড়া, প্রতি ঈদ-উল-আজহায় গরু কিনে কোরবানি দিতেন খোকন-বাবলি দম্পতি। গরু কুরবানির পর মাংসও বিতরণ করতেন খোকন নিজেই। স্থানীয় দোকানদারসহ অনেককেই তিনি কুরবানির গরুর মাংস দিতেন। কুরবানি দিতেন খোকার শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ বাবলির বাবার বাড়ি সিদ্ধেশ্বরীতে। উত্তর শাহজাহানপুরে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে ছিলেন এই দম্পতি। ওই বাড়ির বাসিন্দারাও খোকনকে একজন মুসলমান হিসেবেই জানতেন।

এর আগে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকন নন্দীর প্রথম পক্ষের সন্তান ও তার স্ত্রীর অভিযোগ, হাবিবা আকতার খানম বাবলির জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর বাবার নাম মৃত হাবিবুর রহমান, মায়ের মঞ্জুরা বেগম, জন্ম তারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সাল ও বাসার ঠিকানা ১১/১ সিদ্ধেশ্বরী উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু স্বামী হিসেবে কারো নাম উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে হাবিবা খানম জানান, ভোটার হওয়ার সময় এ বিষয়টি চিন্তা করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকার সময় তাঁর সাথে খোকন নন্দীর পরিচয় হয় পুরানা পল্টনে একটি চটপটির দোকানে। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯৮৬ সালে প্রথম স্ত্রী মীরাকে ডিভোর্স দেন খোকা। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

খোকনের গ্রামের বাড়ি মহেশখালীর জামালপাড়া গ্রামে। পারিবাকির কলহের কারণেই খোকা ধর্মান্তরিত হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা খানম বাবলি জানান। বাবলিকে নিয়ে অনেকবার খোকা কক্সবাজারেও বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁর ভাই-বউদের সাথেও পরিচয় করিয়েছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি চ্যানেলেও তাঁরা সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন আমাকে তারা চেনেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোকন নন্দীর মার্কেটের লোকজন জানান, খোকন ধর্মান্তরিত হওয়ার পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাঁর ছোট ভাই সাগর ছাড়া আর কেউ তাঁকে দেখতে বারডেম হাসপাতালে যেতেন না।

হাবিবা আরও জানান, গত ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে খোকন নন্দী একবার অসুস্থ হন। তখন তাকে কলাবাগানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে কক্সবাজারের মহেশখালীতে থাকা তাঁর ছোটভাই শান্তি নন্দীকে ফোনে বলেছিলেন, তোরা কি আমাকে দেখতে আসবি না? তখন শান্তি বলেছিলেন, আপনি মুসলমান। এসে কি করবো? আমরা তো আপনার লাশও পাবো না। তবে বারডেমে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে এসেছিলেন খোকনের অন্য ভাইয়েরা। আর বারডেমে ভর্তির সময় বাবলি ফোনে ডেকে এনেছিলেন খোকনের ম্যানেজার দুলাল চন্দ্রকে। হাসপাতালের যাবতীয় কাগজে খোকনের নাম খোকন নন্দী লিখিয়েছিলেন দুলাল।

ধর্মান্তরিত হলেও ব্যবসার প্রয়োজনে খোকন তাঁর আগের নামই ব্যবহার করতেন বলে ফার্মগেট ক্যাপিটাল সুপার নামে তাঁর মার্কেটের লোকজন জানিয়েছেন। মোহাম্মদপুর থানাধীন রায়ের বাজারের সুলতানগঞ্জের কাপড় পট্টির ১৫ নম্বর হাজি ভবনের প্রথম তলার ১/সি নম্বর ফ্ল্যাটেও খোকন চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী তাঁর ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকেন। সেখানে থাকার সময় তিনি ধুতি পরে থাকতেন বলে তাঁর পরিচিতরা বলেছেন। আর দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা খানমকে নিয়ে প্রথম স্ত্রীর সাথে তাঁর মাঝেমধ্যে ঝগড়া হতো। দ্বিতীয় স্ত্রী মুসলিম। আর প্রথম স্ত্রী হিন্দু। কেউ কাউকে দেখতে পারতেন না। প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষ থেকে খোকনকে চাপ দেওয়া হতো তালাক দেওয়ার জন্য।

এর আগে খোকন নন্দীর ছেলে বাবলু জানিয়েছেন, তাঁর বাবার লাশের শেষকৃত্য না হওয়ায় তাদের পরিবারের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। লাশ নিয়ে মামলা চলছে। মামলা মামলার মতোই চলবে। তবে এখন বিষয়টি আমার উপর নির্ভর করছে। তাঁর বাবা যেন স্বর্গ লাভ করেন এজন্য গ্রামের বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

খোকন চৌধুরী ওরফে খোকন নন্দীর ফার্মগেটের ক্যাপিটাল মার্কেটের প্রধান সিকিউরিটি গার্ড মোতালেব মিয়া জানান, মার্কেটের সবাই জানেন, মার্কেটের মালিক খোকন নন্দীর লাশ মর্গে পড়ে আছে। এ নিয়ে বেশকিছু দিন আগে মার্কেটের ভেতরে একবার বিচার ডাকা হয়েছিল। ওই বিচারেও কোনো মীমাংসা করতে পারেনি কেউ।

খোকন নন্দীর নামে ক্যাপিটাল মার্কেট রেজিস্ট্রেশন হয় ২০০৪ সালে। কিন্তু তারও ২৪ বছর আগে মুসলিম হন খোকন। তাহলে খোকন নন্দী নামেই কেন রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল দলিল? এই যুক্তি ধরে ধর্মান্তরিত হবার দলিলটিকেই জাল দাবী করছেন খোকনের ভাই বাবুল নন্দী।

মৃত্যুর ৪ মাস পর ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর আদালতের নির্দেশে বারডেম হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে জায়গা হয় খোকন নন্দীর মরদেহের। মুসলিম স্ত্রী হাবীবা মাঝে মাঝে মরদেহ দেখতে গেলেও প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী যাননি একবারও।

সব ধর্মেই দ্রুত মরদেহের শেষকৃত্য করার নির্দেশ দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা, অস্বস্তিকরও। দুই পক্ষই যদি আদালতের কাছে দ্রুত সমাধানের আবেদন করেন, তাহলে আদালত খুব দ্রুত বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। এভাবে একেক পক্ষ থেকে সময় চেয়ে স্টে অর্ডার চাইতে থাকলে, শুধু সময়ই যাবে। সমস্যার সমাধান আর হবে না। তাই এটি সমাধানে উভয়পক্ষকেই নমনীয় হতে হবে।

Link copied!