সায়েমের ‘অসুস্থতায়’ জিয়ার ক্ষমতা দখল?

হাসনাত আসিফ কুশল

এপ্রিল ২১, ২০২৪, ১১:৫০ পিএম

সায়েমের ‘অসুস্থতায়’ জিয়ার ক্ষমতা দখল?

জিয়াউর রহমান। ফাইল ছবি

পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশ বণিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল মীর জাফর, জগৎশেঠ মহাতপ চাঁদ, রায় দুর্লভ, তার ছেলে কৃষ্ণদাস, ঘষেটী বেগমসহ আরও অনেকে। ঠিক একইভাবে স্বাধীন বাংলাদেশেও ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন হলো। তাতে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। ১৯৭৪ সালে বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তুলে খবরের কাগজে ছাপিয়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করা হলো। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ৩১ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হলো এবং বাংলাদেশে আনা হলো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা।

বাকশাল প্রতিষ্ঠার কথা ছিল ৩১ আগস্ট। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তাকে হত্যার পর দেশের অর্থনীতি উল্টোদিকে ধাবিত হতে থাকে। গঠিত হতে থাকে ‘মিনি পাকিস্তান’। ইতিহাসবিকৃতির অতলগহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে জাতি। এই চক্রান্তে শামিল ছিলেন খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ আরও অনেকে। চারদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আস্ফালন এদেশের আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছে। ১৯৭১ সালের মানবতা বিরোধী অপরাধীরা পেতে থাকে দায়মুক্তি। তাদের বসানো হয় প্রশাসনের উচ্চপদে। এমনকি মন্ত্রী পর্যন্তও করা হয় তাদের।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের প্রেসিডেন্ট হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যে মুহূর্তে জাতির জনকের লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনের সিঁড়িতে রক্তাক্ত পড়ে আছে, ঠিক একই মুহূর্তে জাতীয় বেতার ভবনে খোশগল্পে মজে আছেন মেজর শরিফুল হক ডালিমসহ খুনি গং। ২১ আগস্ট এমনই এক পরিবেশে খন্দকার মোশতাক উপস্থিত হলে তাকে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের খবর দেওয়া হয় (তখনও তিনি জানতেন না হত্যাকাণ্ডের খবর)। তার সামনে মুজিবের লাশের ছবি দেওয়া হলে তিনি তখন সেগুলো হাতে নিয়ে দাড়ি চুলকাতে থাকেন আর মৃদু হাসেন। এরপর তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেতারে ঘোষণা দিতে বলা হয়। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক অজু করে এসে রেডিওতে ঘোষণা দেন। প্রকৃতপক্ষে খন্দকার মোশতাক ছিলেন নামমাত্র রাষ্ট্রপতি। তাকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা শুধু ফায়দাই লুটেছে। অর্থাৎ তাকে ব্যবহার করেছে।

জিয়াউর রহমান। ফাইল ছবি

এর মধ্যেই ১৫ আগস্ট পাকিস্তান, ১৬ আগস্ট সৌদি আরব, ১৮ আগস্ট ব্রিটেন, জাপান ও বার্মা, ২১ আগস্ট যুগোস্লাভিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মরক্কো, বেলজিয়াম, ইতালি, আর্জেন্টিনা, লিবিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং ৩১ আগস্ট চীন খন্দকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনই পাকিস্তান সানন্দে বাংলাদেশের খন্দকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। এই দিনেই (১৫ আগস্ট) মার্কিন সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশ হওয়া উদিসা ইসলামের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের পর তিনদিনের মধ্যে সাতটি দেশ স্বীকৃতি দেয় বলে পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। প্রচার করা হয় যে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ব্রিটেনের এই স্বীকৃতি নোটের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। নোটটি মুশতাক আহমেদ সরকারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার (বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিনই মুশতাককে পাকিস্তানের স্বীকৃতি-১৫ আগস্ট ২০২১)।

মওদুদ আহমদ ‘গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’ গ্রন্থে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘৫ নভেম্বর মধ্যরাতে মোশতাক তার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বিদায়ের আগে তিনি একটি সামরিক আইন অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করে যান। এই অধ্যাদেশে বলা হয় যে রাষ্ট্রপতি তার উত্তরসূরি নিয়োগ করে পদত্যাগ করতে পারবেন। সঙ্গে সঙ্গে খালেদ এবং তার অফিসাররা কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসেন এবং পরদিন তাকে দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন।’

খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মোশতাকের বচসা: বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ভুলিয়েভালিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য করেন। তবে তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে জোর করে মন্ত্রিসভায় আনা হয়। কিন্তু শত চেষ্টার পরেও জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অব.) এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানকে মন্ত্রিসভায় নিতে পারেননি খন্দকার মোশতাক। তারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী।

এই চার নেতা ছাড়াও আরও অনেকেই ছিলেন যারা খন্দকার মোশতাকের আহ্বানে সাড়া দেননি। তারা সেই সময় আত্মগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা মোশতাকের আহ্বানে সাড়া দেননি, পাইকারিভাবে তাদের গ্রেপ্তার শুরু হয়। বিশেষ করে খন্দকার মোশতাকের আক্রোশ সবচেয়ে বেশি ছিল জাতীয় ৪ নেতার ওপর। আর তাই তার প্রশাসন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অব.) এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানকে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যখন মোশতাক প্রশাসনের কর্মীরা জাতীয় ৪ নেতাকে গুলি করে হত্যায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ঘটে যায় অভ্যুত্থান। এ দিন আগে থেকেই ঠিক করা হয় খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে প্রধান বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট করা হবে। সায়েম প্রথমে রাজি না হলেও পরে খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিলসহ অন্যদের পীড়াপীড়িতে রাজি হন। কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল রাষ্ট্রপতি হওয়ার অনুরোধ নিয়ে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বাসভবনে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে নিজের ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্যে-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন, ‘৫ নভেম্বর সন্ধ্যায়ই আমরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যাতেই খালেদ মোশাররফ, এম জে তাওয়াব এবং এম এইচ খানসহ আমরা বিচারপতি সায়েমের বাসভবনে গেলাম। সায়েম ধৈর্যসহকারে খালেদের বক্তব্য শুনলেন। এর আগে অবশ্য তাকে একবার বঙ্গভবনে ডেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথাটি জানানো হয়েছিল। যাহোক, সায়েম এখন খালেদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পেয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেন। আমরা কিছুটা পীড়াপীড়ি করায় বললেন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিচারপতি সায়েম তক্ষুনি উঠে গিয়ে ঘরের ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এলেন তিনি। এত তাড়াতাড়ি যে আমাদের মনে হলো যেন এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকলেন তিনি! এ সময়ের মধ্যে কার সঙ্গে কী আলাপ করলেন, তা তিনিই জানেন। তো, সায়েম এসেই বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

এক জনসভায় জিয়াউর রহমান। ফাইল ছবি

বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতি হওয়া নিয়ে সাবেক মন্ত্রী, বিএনপি নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমদ তার ‘সৈনিক জীবন, গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘বেলা দেড়টার দিকে কনফারেন্স রুমে এলেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কুদ্দুস চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিচারপতি)। তিনি অত্যন্ত ঝানু ব্যক্তি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানে যতগুলো সংশোধনী আনা হয়েছে, যেমন ইমার্জেন্সি, মার্শাল ল প্রোক্লেমেশন ইত্যাদি, সব কটিই তার কলম থেকে এসেছে। কুদ্দুস চৌধুরী বললেন, ‘প্রধান বিচারপতি কীভাবে রাষ্ট্রপতি হবেন? সংবিধানে এমন বিধান তো নেই।’ জবাবে আমি বললাম, ‘যেভাবে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন, সেভাবেই চিফ জাস্টিসকে ওখানে বসিয়ে দিন। আপনিই তো হরফুন মওলা। একটু হেসে তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাষণে একটি প্যারা যোগ করে আইনিপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন।’

এদিন বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে চলে বচসা। সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তুলে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বচসার একপর্যায়ে পতন হয় বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক সরকারের। সপরিবারে সিঙ্গাপুরে যেতে বাধ্য হন মোশতাক।

যেভাবে উত্থান জিয়াউর রহমানের: খালেদ মোশাররফের অনুরোধে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি সায়েম। এর মধ্যেই ৬ নভেম্বর আবু তাহেরের নেতৃত্বে শুরু হয় পাল্টা অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থান শেষে খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীদের হত্যা করা হয়। মুক্তি পান জিয়াউর রহমান।

স্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। ফাইল ছবি

সুযোগ সন্ধানী জিয়াউর রহমান ছাড়া পেয়েই নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচারপতি সায়েমকেই বহাল রাখা হয়। ৮ নভেম্বর তার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন বিচারপতি সায়েম। তবে সেটাও বেশ নাটকীয়। ‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বইয়ে প্রাবন্ধিক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘২৯ নভেম্বর (১৯৭৬) জারি হলো সামরিক আইনের তৃতীয় ফরমান। রাষ্ট্রপতি সায়েম ঘোষণা করলেন, ‘যেহেতু আমি এখন উপলব্ধি করছি যে জাতীয় স্বার্থেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিইউ, পিএসসি কর্তৃক প্রয়োগ করা উচিত; সেহেতু এক্ষণে আমি, আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, এই ক্ষেত্রে আমাকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা বলে এবং ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ও ৮ নভেম্বরের ফরমানসমূহের বিধানাবলি সংশোধনপূর্বক এতদ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিইউ, পিএসসি-এর কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তর করছি।’

পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন জিয়াউর রহমান।

উলশী যদুনাথপুরে জিয়াউর রহমান। ফাইল ছবি

‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বইয়ে সুযোগ সন্ধানী জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের বর্ণনা দিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন, ‘জিয়া উপলব্ধি করলেন, বিচারপতি সায়েম একাধারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে থাকলে তার (জিয়ার) জন্য এটা বিপজ্জনক হতে পারে। সায়েম হয়তো আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করবেন। জিয়ার আকাঙ্ক্ষায় ক্রমেই ডালপালা গজাচ্ছিল। নির্বাচন হয়ে গেলে তার স্বপ্ন এখানেই খান খান হয়ে যেতে পারে। জিয়াকে সরিয়ে অন্য কাউকে সায়েম সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে পারেন, এ রকম একটা কানাঘুষাও ছিল। জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, সায়েমকে মাটিতে নামিয়ে আনতে হবে। ২৮ নভেম্বর তিনি বঙ্গভবনে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর, নবম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে। রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারও ওই সময় বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন। জিয়া রাষ্ট্রপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দিতে বললেন।

সায়েম রাজি হলেন না। তার কথা হলো, ‘আমি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছি, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার কাজ আমাকে শেষ করতে দিতে হবে।’ জিয়া তার সিদ্ধান্তে অনড়। মধ্যরাত পর্যন্ত কথা কাটাকাটি চলল। বিচারপতি সাত্তার সায়েমকে বললেন, ‘ভাই, জিয়া যখন সিএমএলএ-এর পদটা নিতে চাইছেন, পদটা আপনি তাকে দিয়ে দিন।’ রাত একটার দিকে সায়েম রণেভঙ্গ দিলেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে সই করলেন। সাঙ্গ হলো মধ্যরাতের আরেকটি ‘ক্যু’।

২৯ নভেম্বর (১৯৭৬) জারি হলো সামরিক আইনের তৃতীয় ফরমান। রাষ্ট্রপতি সায়েম ঘোষণা করলেন, ‘যেহেতু আমি এখন উপলব্ধি করছি যে জাতীয় স্বার্থেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিইউ, পিএসসি কর্তৃক প্রয়োগ করা উচিত; সেহেতু এক্ষণে আমি, আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, এই ক্ষেত্রে আমাকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা বলে এবং ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ও ৮ নভেম্বরের ফরমানসমূহের বিধানাবলি সংশোধনপূর্বক এতদ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিইউ, পিএসসি-এর কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তর করছি।’

জিয়াউর রহমানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণ: জিয়াউর রহমান কেন প্রেসিডেন্ট হলেন তার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন রাজনীতিবিদ ও গবেষক মওদুদ আহমদ। তার গ্রন্থের জিয়াউর রহমানের শাসনকাল অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘খন্দকার মোশতাকের মতো ত্বরিত সিদ্ধান্ত না নিয়ে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপে তার যাত্রা শুরু করলেন এবং নিজেকে যথাসম্ভব অবদমিত করে রাখলেন। বিদ্যমান সৈনিক ও জনগণের অভ্যুত্থান, গোলযোগ ও হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে জিয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সরকারের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করা। এই প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধান বিচারপতিকে বেসামরিক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করায় সেনাবাহিনীর জেনারেলরা আর সমালোচনার শিকার হলেন না। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে জিয়া এবং সিনিয়র সেনা অফিসাররা একমত হলেন যে ভারতীয় প্ররোচনায় সীমান্ত অঞ্চলে ক্রমাগত হামলাজনিত প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা স্থগিত রাখা উচিত। তবে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া চালু রাখার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য বামপন্থী নেতা নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়ে জিয়াকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথেষ্ট সাহায্য করে। ২১ নভেম্বর জিয়া সায়েমকে এই বলে একটি ঘোষণাদানে সম্মত করান যে সীমান্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ ও অব্যাহত সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে একটি ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট’ করতে পারে। একই সঙ্গে সায়েম স্থানীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় যে ইউনিয়ন পরিষদের প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে। এভাবে জিয়া সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার অভিযোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেন।

একই সঙ্গে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে ক্ষমতা আরও সংহত করার লক্ষ্যে জিয়ার প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত। এক সপ্তাহ পরে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জিয়া ক্ষমতার শীর্ষদেশে উঠে আসতে সক্ষম হলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি সায়েম এটা ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন যে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব সেনাবহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর জিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে জিয়া নির্বাহী বিভাগ এবং আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন এবং বিচারপতি সায়েম কেবল একজন ক্ষমতাবিহীন বেসামরিক রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করে রইলেন। জিয়া যখন চূড়ান্ত ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তিনি সায়েমকে ‘ভগ্নস্বাস্থ্যে’র কারণে ইস্তফা দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগের নির্দেশ দিলেন।’

বিচারপতি সায়েমের ভাষ্য: প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দেওয়ার হতাশা প্রকাশ করে বিচারপতি সায়েম এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আশ্চর্যজনক যে বিশেষ সহযোগী, যিনি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, তিনিও সেই দলে ছিলেন। এটা সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক বিশেষভাবে এই কারণে যে বিশেষ সহযোগী ব্যক্তিগতভাবে জানতেন যে তাকে মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা কাউন্সিলে নেওয়া হয়েছে শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়া সক্রিয় করার জন্য এবং তিনি জানতেন যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে, আমাকে এবং তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণসহ কাউন্সিলের সব সদস্যকে মন্ত্রিসভা ত্যাগ করতে হবে। তা করতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি সহজেই আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু উল্টো তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রইলেন। একজন ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সব বেসামরিক সদস্যও তা-ই করেছেন। তাদের সবাইকে মনোনীত করেছিলাম এবং নিয়োগ দিয়েছিলাম আমি। কাউকে কটাক্ষ করার জন্য বলছি না। এ দেশের বর্তমান রাজনীতিকদের মানসিক গড়ন সম্পর্কে আমার ধারণা এ থেকে ফুটে ওঠে।’

জিয়াউর রহমান যেদিন প্রেসিডেন্ট হলেন, তার পরদিন ২২ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদের মূল শিরোনাম ছিল-‘প্রেসিডেন্ট পদে জেনারেল জিয়া’। এই সংবাদে বলা ছিল, ‘বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করায় সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছেন। বাসস জানায়, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি গতকাল ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টের ঘোষণার বিধান অনুসারে জেনারেল জিয়াকে দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন। বিকাল পাঁচটা ৩৫ মিনিটে বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।’

তবে বিচারপতি সায়েম ‘ভগ্ন স্বাস্থ্যের’ জন্য পদত্যাগ করেছেন সেটা সত্য নয়। জিয়াউর রহমানের জোরজবরদস্তির কারণেই তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। পরে জিয়াকে মহান করে ‍তুলতেই ‘ভগ্ন স্বাস্থ্যের’ এই অজুহাত তোলা হয়। ১৯৭৮ সালের শুরুর দিকে ইংরেজিতে একটি স্মৃতিকথায় বিচারপতি সায়েম জিয়ার এই মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে ওই স্মৃতিকথা প্রকাশের আগেই ১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই মারা যান তিনি। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মৃত্যুর পর ভোরের কাগজে ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’-এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। অনুবাদ করেছিলেন মশিউল আলম। সেটি পরে ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা লিখে গেছেন। এমনকি তার বেসামরিক উপদেষ্টা বা বিশেষ সহযোগীদের ভূমিকার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলা ট্রিবিউন, ১৫ আগস্ট ২০২১;
২. বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ আগস্ট ২০২৩;
৩. প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল ২০২৪;
৪. বিবিসি, ৩ নভেম্বর ২০১৬;
৫. মহিউদ্দিন আহমদ, ‘বিএনপি: সময়-অসময়’;
৬. হাফিজ উদ্দিন আহমদ, ‘সৈনিক জীবন, গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’;
৭. কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্যে-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’;
৮. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ‘গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’;
৯. সচিত্র বাংলাদেশ, আগস্ট ২০২৩, শ্রাবণ-ভাদ্র ১৪৩০;
১০. বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’ (ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত), ভোরের কাগজ;
১১. বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি।

লেখক: সাংবাদিক, ইতিহাস বিশ্লেষক

Link copied!