সংসদে তোপের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

নিজস্ব প্রতিবেদক

এপ্রিল ৬, ২০২২, ১২:০৪ এএম

সংসদে তোপের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে প্রচণ্ড তোপের মুখে পড়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিু মুনশি। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে বিরোধীদলীয় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের দাবি ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’ 

মঙ্গলবার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বাণিজ্য সংগঠন বিল পাসের প্রক্রিয়াকালে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মোকাব্বির খান এমপি

উত্থাপিত বিলের ওপর আলোচনকালে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানবলেন, ‘বাজারে গেলে দেখা যায়, বাজারের ওপরের সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো বাজারটাই সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দরিদ্রের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তরা টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছে।’ 

মন্ত্রীরা ব্যর্থতার দায় শিকার না করে অকাট্য, হাস্যকর যুক্তি তুলে ধরছেন বলে মন্তব্য করেন করেন মোকাব্বির।

দেশের মানুষ এগুলো প্রত্যাশা করে না উল্লেখ করে গণফোরামের এই সংসদ সদস্য বলেন, “জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার চিত্র এটা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে, কিন্তু কবে যে সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্ত হবে, সেটা আল্লাহ জানেন।”

হারুনুর রশীদ

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ে মন্ত্রীরা জাতির সঙ্গে উপহাস করছেন উল্লেখ করে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বলেন, “তারেক রহমান নাকি লন্ডনে বসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। বিএনপি নাকি দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। এই সব বক্তব্য যখন দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের জায়গা থেকে আসে। তখন এগুলোর কী উত্তর দেব।”

গ্যাসের কারণে ঢাকায় হাহাকার চলছে-জানিয়ে বিএনপির এই সাংসদ আরও বলেন, “ দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। রমজান মাসে মানুষ কীভাবে তাদের জীবন-জীবিকা চালাবে? গ্যাস ও তেলের দাম বাড়াচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সরকার যে ব্যর্থ। কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। কিছু পণ্যের ওপর ট্যাক্স ও শুল্ক কমিয়েছেন। সেটা ঠিক আছে। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।” তবে এগুলোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

হারুনুর রশীদ আরও বলেন, “ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।”

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

সরকার আর সিন্ডিকেটের মধ্যে পার্থক্য নেই-মন্তব্য করে  বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, “তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে হইচই হলো। ১৫ দিনে সিন্ডিকেট এক হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে।” ‘সিন্ডিকেট হলো সরকার’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

কাজী ফিরোজ রশিদ

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির একিাধিক সংসদ সদস্য। দ্রব্যমূল্যের দাম শুধু বৈশ্বিক কারণে বাড়েনি উল্লেখ করে কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, “গরুর মাংসের দাম বাড়ছে, এটাতো রাশিয়া থেকে আসে না। যুদ্ধের কারণে না। এই দেশের গরুর মাংসের দাম হঠাৎ করে কেন বাড়ল। বাড়ে এই কারণে, সেটা হলো সিন্ডিকেট।”

তিনি বলেন, “গরু আনতে গেলে প্রতিটি জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। মার্কেট বসলে চাঁদা দিতে হয়, নানা রকমের উৎপাতের সামনে ব্যবসা করতে হয়। চাঁদা ছাড়া ফুটপাতে চা দোকান করতে পারে না।সিন্ডিকেট করে একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। রমজান মাসে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।” 

মুজিবুল হক চুন্নু 

জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হকন চুন্নু  বলেন, ‘সাধারণ মানুষ ইফেকটেড হচ্ছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কঠোরভাবে বাজার নজরদারি করতে হবে। “

সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সিন্ডিকেট মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে না জানিয়ে জাতীয় পার্টির এই সাংসদ আরও বলেন, “ বলা হয় যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলোর দাম বাড়তে পারে। যেগুলো যুদ্ধের আগে আমদানি করা হয়েছে এবং যেগুলো দেশি পণ্য সেগুলোর কেন দাম বাড়বে।” প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবি জানান তিনি।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী

জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “সাধারণ মানুষ এখন পুষ্টিমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে যে লেবু ২ টাকা সেটা ঢাকায় ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রীকে আবার যুদ্ধ করতে হবে।” 

পীর ফজলুর রহমান

জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, “আজকে সংবাদপত্রে এসেছে তিনি (বাণিজ্যমন্ত্রী) গতকাল বাজারে গেছেন এবং তিনি ২৮ টাকা কেজিতে ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন। এখন মাননীয় মন্ত্রী যদি ঘোষণা দিয়ে একটু কাঁচা বাজার, সবজি বাজারসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে যেতেন মানুষও ওই বাজারে যেতে পারত এবং মন্ত্রীর মতো কম দামে জিনিস কিনতে পারত। কারণ ওনি যতই ভ্যাট কমিয়ে মূল্য কমানোর চেষ্টা করছেন, প্রকৃতপক্ষে বাজারে পণ্যের দাম অত কমে নাই।” 

ফখরুল ইমাম

জাতীয় পার্টির অঅরেক সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, “অ্যাপোলো (এভারকেয়ার) হাসপাতালে গেলে লক্ষাধিক টাকা বিল এলে, বাজারে গেলে বেশি দাম দেখে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে।”

এছাড়া, একই দলের আরেত সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বাণিজ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, “সরকার ধরলে দাম কমে আবার যখন সরকার শিথিলতা দেখায় তখন আবার দাম বাড়ে।” একটার দাম কমলে আরেকটার দাম বাড়ে-এটা একটা লুকোচুরি খেলার মতো’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিরোধীদলীয় এমপি’দের বক্তব্যের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী

জাতীয় পার্টি ও বিএনপির বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যদের এমন ক্ষোভ প্রকাশের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, এটা আমি কখনো বলিনি। প্রতি মাসে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। এখন বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।’

সরকার কোথাও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে না বরং ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে-উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “ যে কেউ চাইলে তেল আমদানি করতে পারে। সরকার সিন্ডিকেট এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।”

টিপু মুনশি বলেন, “সিন্ডিকেট বলে যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা কেউ রাজনীতি করেন না, তারা কেউ এমপি নন। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত ফলোআপ করছেন’ বলেও তিনি জানান।

Link copied!