ভয়ংকর পুতুলের দ্বীপ!

পাপিয়া মামুন

জুলাই ৪, ২০২৪, ০৫:২৭ পিএম

ভয়ংকর পুতুলের দ্বীপ!

প্রতীকী ছবি

কখনও কী এমন কোনও দ্বীপের কথা শুনেছেন যে দ্বীপের বাসিন্দা শুধুই পুতুল। এই দ্বীপে মিলবে না কোনও মানুষের সন্ধান। চারিদিকে সবুজ, নিস্তব্ধতার মাঝে বাতাসে দোল খাচ্ছে হাত, পা- মাথাবিহীন ভয়ঙ্কর সব পুতুল। দ্বীপটির পরিবেশ সব মিলিয়ে গা ছমছমে। ওইসব পুতুলের কোনওটার হাত নেই, কোনওটার পা নেই, আবার কোনওটার চোখ বা মাথা নেই। মেক্সিকো সিটি থেকে ১৭ মাইল দক্ষিণে সোচিমিলকোতে এই রহস্যময় পুতুল দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপটি ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। কথিত আছে, এই দ্বীপে পুতুল নিয়ে খেলছিলো তিন মেক্সিকান শিশু। খেলাচ্ছলে তারা পুতুলের বিয়ে দেয়। এ সময় হঠাৎ একটি শিশু উধাও হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাশের একটি খালে শিশুটির মরদেহ পাওয়া যায়। সেই থেকে সাধারণ মানুষের কাছে এই দ্বীপটি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর এক দ্বীপ। নির্জন দুপুরে বা একটু সন্ধ্যা নেমে এলেই এই দ্বীপের অধিবাসীরা শুনতে পান এক কিশোরীর কান্নার ধ্বনি। কখনও বা হাসির আওয়াজ।

তবে দ্বীপে এতো পুতুল আসার পেছনে রয়েছে অন্য আরেকটি ঘটনা। ১৯৫০ সালের দিকে এই দ্বীপটিকে ধ্যান করার জন্য বেছে নেয় ডন জুলিয়ান সানতানা নামের এক ব্যক্তি। ঐ লোকটির কাছে নাকি মৃত শিশুটির আত্মা আবদার করেছিলো অনেক পুতুল এনে দ্বীপের চারপাশে টাঙিয়ে দেওয়ার জন্য। শিশুটির আত্মাকে খুশি করার জন্য জুলিয়ান তার আশ্রমে চাষের সবজির বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে নষ্ট পুতুল সংগ্রহ করে  দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় টাঙিয়ে দিতো। এভাবেই দ্বীপের প্রত্যেকটি গাছে এবং পরিত্যক্ত বাড়িতে ঝুলে আছে পুতুলগুলো। অনেকের মতে, এই ভৌতিক উপদ্রবকে ঠেকাতে মৃত আত্মাকে তুষ্ট করতে দ্বীপবাসীরা দ্বীপের সব গাছে পুতুল ঝোলাতে শুরু করেন। সেই থেকে গোটা দ্বীপটিতে আজ অসংখ্য পুতুলের ছড়াছড়ি। আত্মার শান্তি কামনার জন্য গাছের ডালে ডালে পুতুল ঝোলানোর এই রীতি আরও দৃঢ়ভাবে প্রচলিত হতে শুরু করে ২০০১ সাল থেকে। কেননা ২০০১ সালে ডন জুলিয়ানের রহস্যজনকভাবে মৃত্য হয়। যে নালায় বাচ্চা মেয়েটির মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সেখানেই ডুবে মারা যান জুলিয়ান। এরপর থেকে পর্যটকরা জুলিয়ান এবং ছোট মেয়েটিকে শ্রদ্ধা জানাতে দ্বীপে পুতুল নিয়ে আসতো। পুতুল এনে পর্যটকরা গাছে ঝুলিয়ে রাখতো। পরবর্তীকালে জুলিয়ানের পরিবার এইসব বিষয় অস্বীকার করে জানায়, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না।জুলিয়ানের মৃত্যুর পর ২০০১ সাল থেকেই ওই দ্বীপটির নাম “চায়নাম্পাস”নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।এখানেই শেষ নয়, এই সব পুতুল ঘিরে নানান ভৌতিক কাহিনী রচনা করেছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে , রাতের অন্ধকারে নাকি পুতুলরা জীবন্ত হয়ে ওঠে, তারা ফিস ফিস করে কথা বলে নিজেদের মধ্যে! লোক-কাহিনী আছে যে, পুতুলগুলোর বিচ্ছিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের অংশ বিশেষ, বিশেষত মাথা- হাত-পা নাকি মাঝে মাঝে নড়াচড়া করতেও দেখা যায়। আবার অনেকে নাকি পুতুলগুলোর চোখ খুলতে ও বন্ধ করতেও দেখেছেন। অনেক সময় নাকি পুতুলগুলো দ্বীপের সন্নিকটে কোনও বোট যেতে দেখলে বোটের লোকগুলোকে ঈশারায় দ্বীপে নামতে বলে।এই দ্বীপে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। পর্যটকরা গেলেও সেখানে যান দল বেঁধে। চারপাশে এত বিভৎস পুতুল দেখে অনেকেই রীতিমতো ভয় পান। অনেকে বলেন সেখানে মৃত মানুষের চিৎকার তারা শুনতে পেয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না- মুখে মুখে এমন অনেক কথাই ছড়িয়ে পড়ে।

ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালেই চায়নাম্পাসকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেও তা টুরিস্ট প্লেস হিসেবে জমজমাট হয়ে উঠতে পারেনি। সিনডি ভাস্কো নামের একজন ফটোগ্রাফার এই দ্বীপ ভ্রমণ শেষে তার অভিজ্ঞতা মেইল মারফত শেয়ার করেন। তাতে তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কীভাবে অপার সৌন্দর্যের মাঝে পাড়ি জমাতে জমাতে হঠাৎ সেই ভয়ংকর পুতুল ঘেরা দ্বীপে পৌঁছে গিয়েছিলেন। যারা ভূত দেখার বা তার অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করেন তারা ঘুরে আসতে পারেন মেক্সিকোর এই “আইল্যান্ড অফ দ্যা ডলস”এ।এরপর ১৯৯০ সালে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য এই দ্বীপটিকে ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ ঘোষণা করে মেক্সিকান সরকার। দ্বীপটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পর্যটন এলাকা বানানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু পর্যটকরা কদাকার পুতুল দেখে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন বলে সেখানে যেতে চান না। আর সেখানে কোনও পর্যটক গেলে এখনও সঙ্গে করে পুতুল নিয়ে যান এবং টাঙিয়ে দেন দ্বীপের কোনও এক জায়গায়।উল্লেখ্য, এটি মূলত কুমিরের দ্বীপ হিসেবেই পরিচিত। রেকর্ড বুকে এই দ্বীপটি নাম লিখিয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষকে আহত করার কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে বাঁচতে জাপানী সেনাবাহিনীর এক হাজার সৈনিক এই দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলো। কিন্তু জানলে অবাক হবেন যে, সে সময় এই কুমিরের দ্বীপটি থেকে মাত্র ২০ জন সৈন্য বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন।

Link copied!