বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। শৈশবে তাকে সবাই ডাকতো রাণী বলে। বিপ্লবী জীবনে তার ছদ্ম নাম ছিল ফুলতার। তিনি জন্মেছিলেন ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে দ্রোহ কালে। তিনি ২১ বছর, ৪ মাস ১৯ দিনের একটি ছোট্ট জীবনযাপন করে গেলেন। আর পৃথিবীর ইতিহাসে অমরত্বের বিরাট ফলকে নিজের নামটি খোদাই করে গেলেন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, আমাদের প্রীতিলতা, আমাদের অহংকার। একজন বাঙালী রমনী, যিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ। তার বাবা ছিলেন জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভাদেবী। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের মেয়েটি ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদি কাজে মা-কে সাহায্য করতেন ঠিক অন্য দশটা বাঙ্গালি কিশোরির মতোই। কিন্তু তার বুকের ভেতরে ছিল প্রতিবাতী আগুনও।
১৯১৮ সালে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। শিক্ষকদের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাই’য়ের ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। ১৯২৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বি.এ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তার এবং তার সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়।
সেই সময়টা ছিল দ্রোহ কাল। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাসের মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা সরকারী কর্মচারীদের বেতনের ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করেন। ১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হন। সে সময়ে বাংলার বিপ্লবিদের অনুপ্রেরণা ছিলেন বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, কানাইলালগণ। ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠন ছিল। শ্রীসংঘের ‘দীপালী সংঘ’ নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। প্রীতিলতা দীপালী সংঘে যোগ দেন। এটি ছিলো এক ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। ইতিহাসে এটি `চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ`। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবীদলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্র সমাজকে উদ্দীপ্ত করে। বি.এ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়ি এসে দেখেন তার পিতার চাকরি নেই। সংসারের হাল ধরতে তিনি নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। বর্তমানে এটি অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। এরই ফাঁকে ফাঁকে তিনি হয়ে যান পুরোধা একজন বিপ্লবী। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকের কোন একদিন নির্মল সেন প্রীতিলতাকে ‘পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে’ তা জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘টান আছে। কিন্তু ডিউটি টু ফ্যামিলিকে ডিউটি টু কাউন্ট্রির কাছে বলি দিতে পারব।‘
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। এই বছরগুলোতে আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীরা নুতন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারলোনা। এসব পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন। এই দুজন আত্মগোপণকারী বিপ্লবী তখনো গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়িটা। বিপ্লবীদের কাছে ঐ বাড়ির গোপন নাম ছিল `আশ্রম`।
১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড়-বৃষ্টির দিনে মাষ্টারদার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। বাড়িতে প্রীতিলতা তার মাকে সীতাকুন্ড যাবার কথা বলেন। মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন ছাড়া ঐ বাড়িতে আরো ছিলেন ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক আসামী তরুন বিপ্লবী অপূর্ব সেন যাঁর ডাক নাম ছিলো ভোলা। ১৩ জুন সন্ধ্যায় সূর্য সেন এবং তার সহযোগীদের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পারে এবং ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে ব্রিটিস বাহিনী হানা দেয়। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের করা দুইটা গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরণ করে এবং সন্মুখ সমনে নির্মল সেনও মৃত্যুবরণ করেন। প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাষ্টারদা অন্ধকারে ঘরের বাইরে আসেন। মাস্টার দা সূর্যসেন পরের দিন প্রীতিলতাকে বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব বিপ্লবীরা ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল আক্রমণ করতে গিয়ে পারেনি। কারণ, সেদিন ছিলো গুড ফ্রাইডে। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড়ে ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা ব্যতীত এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ঐ ক্লাবের ধারে কাছে যেতে পারতো না। সেখানে লিখা ছিল, কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ`!
সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতো। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নুতনভাবে পরিকল্পনা শুরু করেন। চট্টগ্রাম শহরের কাছে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে ঐ ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় পেলেন। ১৯৩২ এর ১০ আগষ্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন আবারও ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থেকেও থাকে, তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্র সৈকতে তার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।
মাষ্টারদা ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব এবার তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলেন মনস্থির করলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ে গেলেন। এবার আক্রমণের নেতৃত্বের ভার নিতে চাইলো একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা। সদস্য সংখ্যা হলো পনের জন। ২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেওয়ার জন্যে মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা।
বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০ টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘনঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। যেন পাহাড়তলীতে কেঁপে উঠেছিলো খোদ ব্রিটিস সাম্রাজ্য। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগলো। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিলো। তারা পাল্টা আক্রমণ করলো। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। সেদিনের সেই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ ও সাতজন মহিলা আহত হয়।
আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন এবং যারা আহত হয়নি সেসব বিপ্লবীদের দ্রুত স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবীরা শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর দিনটি ছিলো ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে এসব সোনার মানুষ নিজেদেরকে দিয়েছিলেন কোরবানি। আমরা তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি। আমরা তাদের ভুলব না কোনোদিন।