হলিউড কিংবদন্তি স্টিভেন স্পিলবার্গ বলেছেন, দুনিয়ার অন্য কোনো ফিল্মমেকারের কাছ থেকে আমি যতটা না শিখেছি আকিরা কুরোশাওয়ার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি তারও অধিক।
জাপানের টোকিওতে ১৯১০ সালের ২৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন আকিরা কুরোশাওয়া। বাবা ইসামু ছিলেন তৎকালীন সামুরাই পরিবারের সদস্য। আর মা শিমা ছিলেন ওসাকার বণিক পরিবারের কন্যা। আকিরা বাবা-মায়ের অষ্টম এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। আজ মহান এই চলচ্চিত্রকারের প্রয়াণ দিবস। ১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাপানের টোকিওতে মৃত্যুবরণ করেন সিনেমার সামুরাই এই অমিত প্রতিভাবান পরিচালক।
ছেলেবেলা
সিনে-পরিবারে জন্ম নেওয়ায় ছোটবেলা থেকেই প্রচুর ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছেন আকিরা কুরোশাওয়া। সিনেমা দেখার পাশাপাশি তার ঝোঁক ছিল আঁকাআঁকিতে। স্কুলের পড়াশোনা শেষে ছবি আঁকার প্রতি তার আগ্রহ ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং ১৭ বছর বয়সেই চিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
চিত্রকলায় অমনোযোগীতা
১৯৩২ সালে চিত্রকর হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও মন বসাতে পারছিলেন না। নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলেন আকিরা। ১৯৩৫ সালের এক সকালে তার চোখ আটকে যায় দৈনিকের পাতায়। ফিল্ম স্টুডিও ফটো কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিজের বিজ্ঞপ্তি দেখে সহকারী চিত্রপরিচালক পদে আবেদন করেন এবং কাজিরো ইয়ামামোতোর নির্দেশনায় শ্রুতিচিত্র নির্মাণ কাজে নিযুক্ত হন। ইয়ামামোতো সহকারী হিসেবে আকিরাকে যত না পছন্দ করতেন, ততোধিক ভালোবাসতেন সিনেমা ছাড়াও জগতের অন্য সব বিষয়ে তার জ্ঞানের কারণে। আকিরা নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে ইয়ামামোতোর ছবির জন্য পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করেন এবং একেকটা সিকোয়েন্সের নির্দেশনাও দিতে থাকেন।
এরপরই সেলুলয়েডে পথচলা
কয়েকটি ছবিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করার পর তিনি ১৯৪১ সালে দুটি চিত্রনাট্য লিখে পুরস্কার লাভ করেন। একই সময়ে জাপানের নবগঠিত চলচ্চিত্র স্টুডিও তোহা কোম্পানির প্রধান পরিচালকের পদ লাভ করেন এবং পরিচালক হিসেবে তার অভিষেক ঘটে। ছবির নাম সুগাতা সানশিরো। মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে। প্রথম ছবিতেই পরিচালক হিসেবে তার প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়। ছবিটি দর্শক ও বোদ্ধা-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়।
রশো-মন এবং তারপর
বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের মাইলফলক, আকিরা কুরোশাওয়ার অসাধারণ সৃষ্টি রশো-মন মুক্তি পায় ১৯৫০ সালে। ছবিটি ১৯৫১ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার লাভ করে। বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিন টাইম ও চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান এএফআইসহ অনেক চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন কর্তৃক নির্বাচিত সর্বকালের সেরা ছবির তালিকায় এ ছবিটির নাম রয়েছে। এসব কারণে শুধু কুরোশাওয়া নন, জাপানি চলচ্চিত্র সারা বিশ্বের নজরে পড়ে।
কাজের বৈশিষ্ট্য
আবেল গাঁস, জন ফোর্ড, হাওয়ার্ড হকস, জর্জ স্টিভেন, ফ্র্যাংক কাপরা, উইলিয়াম ওয়াইলার প্রমুখ চলচ্চিত্রকারের কাজ আকিরা কুরোশাওয়ার অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু তিনি কাউকে অনুকরণ করতেন না। আকিরা কুরোশাওয়া ছবি নির্মাণ করতেন একেবারেই নিজস্ব ঢঙে। তার প্রতিটি ছবির স্বকীয়তা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো।
বিশ্বের অনেক পরিচালক তার কাজে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত। তার নির্মিত বেশ কয়েকটি ছবি হলিউড, বলিউডসহ পৃথিবীর অনেক দেশে পুনর্নির্মিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সেভেন সামুরাই-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর হলিউড সংস্করণ হচ্ছে দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন ও বলিউড সংস্করণ শোলে। হলিউডের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার স্টিভেন স্পিলবার্গ তো বলেই ফেলেছেন- ‘দুনিয়ার অন্য কোনো ফিল্ম মেকারের কাছ থেকে আমি যতটা না শিখেছি, আকিরা কুরোশাওয়ার কাছ থেকে নিয়েছি-শিখেছি তার চেয়ে অনেক বেশি।’
উল্লেখযোগ্য ছবি
সুগাতা সানশিরো (১৯৪৩), রশো-মন (১৯৫০), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪), র্যান (১৯৮৫), কাগেমুশা (১৯৮০), দেরসু উজালা (১৯৭৫), ইকিরু (১৯৫২), দ্য থ্রোন অব ব্লাড (১৯৫৭), স্ক্যান্ডাল (১৯৫০), ড্রিমস (১৯৯০), মাদাদায়ো (১৯৯৩), র্যাপসোডি ইন অগাস্ট (১৯৯১), দ্য হিডেন ফরট্রেস (১৯৫৮), রেড বিয়ার্ড (১৯৬৫) ইত্যাদি।
পরিবার-ঘর-সংসার
১৯৪৪ সালে সুন্দরীদের নিয়ে একটি ছবি করছিলেন আকিরা। ‘দ্য মোস্ট বিউটিফুল’ নামের ওই ছবিতে কাজ করছিলেন ইয়োকো ইয়াগুচি। কাজ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক বছরের সম্পর্ক পরিণতি পায় ১৯৪৫ সালের ২১ মে। এরপর আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি ইয়াগুচি। তাদের ছেলে হিসাও বাবার প্রোডাকশনের দায়িত্বে ছিলেন এবং মেয়ে কাজুকো ছিলেন কস্টিউম ডিজাইনার। ১৯৮৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৬৩ বছর বয়সে মারা যান ইয়োকো ইয়াগুচি। বাকি জীবনটা দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন আকিরা।
স্বীকৃতি
আকিরা কুরোশাওয়া বিশ্বের অনেক মহান সাহিত্যিকের নাটক ও উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, ফিওদর দস্তয়ভস্কি ও ম্যাক্সিম গোর্কি অন্যতম। তিনি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রজগতে সক্রিয় থেকে ৩১টির মতো ছবি নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৯০ সালে সম্মানসূচক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তার নির্মিত র্যান ছবিটি ১৯৮৬ সালে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়। এ ছাড়াও বাফটা, কান, ভেনিসসহ পৃথিবীর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। আকিরা কুরোশাওয়া মোট ৬১টি পুরস্কার জেতেন এবং ১৭টির জন্য মনোনয়ন লাভ করেন। সানফ্রান্সিসকো ও টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আকিরা কুরোশাওয়ার নামে চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি কর্তৃক নির্বাচিত সর্বকালের সেরা পরিচালকদের মধ্যে আকিরা কুরোশাওয়ার অবস্থান ষষ্ঠ।