আমাদের কৃষি গবেষণার পথিকৃৎ কাজী বদরুদ্দোজা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ৩১, ২০২৩, ০২:৫২ এএম

আমাদের কৃষি গবেষণার পথিকৃৎ কাজী বদরুদ্দোজা

১৯৭৪ সালের কথা। ফার্মগেটের খামারবাড়িতে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের সব বন্দোবস্ত চূড়ান্ত। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও খামারের ওই জমিতে হোটেল নির্মাণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়ে গেছে। এই খবর পেয়ে কাজী এম বদরুদ্দোজা ছুটে গেলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। গিয়ে বললেন, কৃষি গবেষণার জমিতে তিনি হোটেল বানাতে দেবেন না। 

বঙ্গবন্ধু বললেন, কেন? উত্তরে কাজী বদরুদ্দোজা বললেন, ‘এটা হলে কৃষির মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এই জমিতে হতে হবে কৃষি গবেষণার জন্য প্রশাসনিক সমন্বয়ের প্রধান কার্যালয়।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুই ঠিক কী চাস,আমার কাছে লিখে নিয়ে আয়।’ 

বঙ্গবন্ধুর সহকারীর কক্ষে গিয়ে কাজী বদরুদ্দোজা বাংলাদেশ ‘কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’ (বার্ক)–এর গঠনকাঠামো ও কার্যপরিধি এবং প্রস্তাব লিখে নিয়ে এলেন। বঙ্গবন্ধু তাতেই স্বাক্ষর করে অনুমোদন দিয়ে দিলেন। জন্ম নিল বাংলাদেশের কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী এই প্রতিষ্ঠান।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), সাভারে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বাকৃবি ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ), ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (ইপসা), বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছেন কাজী এম বদরুদ্দোজা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গঠনেও কাজ করেন তিনি। ভিয়েতনামের ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক্স, পাকিস্তানের এরিড জোন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরিতেও ভূমিকা ছিল তার।

একজন কাজী বদরুদ্দোজার জন্ম

অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন, কে এই কাজী এম বদরুদ্দোজা? একজন ব্যক্তির কী এমন ক্ষমতা যে এত কিছু তিনি একাই করে ফেললেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ১৯২৭ সালে বগুড়ায় জন্ম নেওয়া এই কৃষিবিজ্ঞানীর অতীতের দিকে একটু তাকাতে হবে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা বগুড়ায় এসেছিলেন ভারতের মিরাট থেকে, সেখানকার নবাবদের বংশধর ছিলেন তাঁরা। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম সিপাহি বিদ্রোহে এই পরিবারের সদস্যরা যুক্ত ছিলেন। এতে ইংরেজ শাসকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে নিজেদের জীবন বাঁচাতে ভারত থেকে পালিয়ে এ দেশের মাটিতে আশ্রয় নেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়া ওই পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজী ছোটবেলা থেকেই মেধাবৃত্তির টাকা এবং টিউশনি করে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৪৫ সালে এসে ভর্তি হলেন উপমহাদেশের প্রথম কৃষি কলেজ তেজগাঁওয়ের বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে।

আইনজীবী হতে চেয়ে কৃষিবিদ

মা–বাবার ইচ্ছে ছিল তিনি চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হবেন। তাঁর নিজের ইচ্ছে ছিল তিনি ভালো আইনজীবী হবেন। সেই মেধা তাঁর যথেষ্টই ছিল। কিন্তু মা-বাবার ইচ্ছা বা নিজের ইচ্ছা কোনোটাই পূরণ হয়নি। হয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানী। মূলত আর্থিক সংগতি না থাকার কারণেই নিজের জীবনকে এভাবে সাজাতে হয়েছে বলে মনে করেন ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে কাজ করতে এসে বুঝেছেন ‘অভাব’ তাঁর জীবনে কী অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে মানুষের জন্য কাজ করার, এ দেশের কৃষির জন্য অবদান রাখার। দারিদ্র্য সত্যিকার অর্থেই তাঁর জীবনকে মহান ও মহৎ করে তুলেছে। কাজী এম বদরুদ্দোজার নিরলস পরিশ্রম ও একাগ্র সাধনার ফলে এ দেশের কৃষক ও কৃষি পেয়েছে আধুনিকতা ও উন্নয়নের ছোঁয়া।

১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি-অ্যাগ্রি ডিগ্রি শেষ করার আগে কাজী ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে বিভাগীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনুমোদনে অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে একজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে সঠিকভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন ও নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য তিনি ‘ফুলব্রাইট’ স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রপ বোটানিতে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ দেশে ফিরে এসে কৃষি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। এরপর থেকে সারা জীবন তিনি নিজের গবেষণা এবং এ দেশের কৃষির উন্নতির জন্যই ব্যয় করে গেছেন।

বিদেশের জ্ঞান দেশে আনলেন

১৯৫৭ সালে বদরুদ্দোজা ইকোনমিক বোটানিস্ট (ফাইবার) পদ লাভ করেন। সেই সময়ের কৃষকদের কাছে ফসল বলতে ছিল প্রধানত ধান ও পাট। স্বল্প পরিচিত ফসল গম ও ভুট্টা চাষ সম্পর্কে জানার জন্য তিনি সুইডেনের বিশ্বখ্যাত স্তালভ গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এর পরপরই লুগন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ ইন জেনেটিকস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে দেশে ফেরেন এবং নতুন উদ্যমে কৃষি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক, নির্বাহী পরিচালক ও মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল গম প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেন।

দেশে আধুনিক জাতের গম উদ্ভাবন ও চাষ শুরু করেন কাজী এম বদরুদ্দোজা, এমনকি ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদও তার মাধ্যমে শুরু হয়। ভুট্টা থেকে তেল উদ্ভাবন এবং তা পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরুর ধারণাটিও তারই ছিল। ২০১২ সালে এসব অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‍‍`স্বাধীনতা পুরস্কার‍‍` পান এই বিজ্ঞানী।

এতো অবদান যার, তার নামে নতুন উদ্ভাবিত পেয়ারার নাম রাখাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়!

বুধবার (৩০ আগস্ট) ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কৃষি বিজ্ঞানী কাজী এম বদরুদ্দোজা মারা গেছেন।

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

বদরুদ্দোজা ঢাকার উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র, এক কন্যা রেখে গেছেন।

Link copied!