অনন্য বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ২৩, ২০২১, ০৪:৫৩ পিএম

অনন্য বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন অন্যতম বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার স্বকীয় জীবনমুখী লেখনী তাকে দিয়েছে বাঙালা সাহিত্যে অনন্য আসন। আজ ২৩ জুলাই এই কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিকের ১২৩ তম জন্মদিন।

জন্ম ও পরিচয়

১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা-মায়ের নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রভাবতী দেবী। তারাশঙ্কর ছোটবেলায় মাদুলি, তাবিচ, কবচ এবং বহু সংস্কারের গন্ডিতে বড় হয়ে ওঠেন। আসলে সততা, ধর্মভাব, ভক্তি ও ধর্মশাস্ত্রীয় বিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। যদিও পরবর্তী জীবনে এ সব বিশ্বাস নিয়ে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও জিজ্ঞাসা তার মনকে আলোড়িত করেছে। প্রগতিশীল চিন্তার শরিক হয়েছেন। তারাশঙ্করের বাল্যজীবন কাটে গ্রামের পরিবেশেই গ্রামের স্কুল থেকে।

শিক্ষা জীবন

তারাশঙ্কর লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং পরে সাউথ সুবার্বন কলেজে (এখনকার আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। স্বাস্থ্যভঙ্গ এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে তার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেপ্তার হলেও পরে মুক্তি পেয়ে যান। এরপর নিজেকে সাহিত্যে নিয়োজিত করেন। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। একই বছরে তার প্রথম উপন্যাস "চৈতালী ঘূর্ণি" প্রকাশ পায়।

তারাশঙ্কর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বাগবাজারে একটি বাড়ি ভাড়া করে নিজের পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে আসেন ও ১৯৪১-এ তিনি বরাহনগরে চলে যান। তারাশঙ্কর ১৯৪২-এর বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংগঠনের সভাপতি হন। তিনি ১৯৭০ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন

তারাশঙ্কর কংগ্রেসের কর্মী হয়ে সমাজসেবামূলক কাজ করেন এবং এর জন্য তিনি কিছুদিন জেলও খাটেন। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য হন।

লেখার বৈশিষ্ট্য

তার লেখায় বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, তারাশঙ্কর তার সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তার লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তার অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। সেখানে আরও আছে গ্রাম জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা।

চলচ্চিত্র

তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। তার যেসব রচনা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে সেগুলির মধ্যে আছে: জলসাঘর ও অভিযান, সত্যজিৎ রায়-এর পরিচালিত, অগ্রদানী, [পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, আগুন , আরোগ্য নিকেতন [বিজয় বসু, উত্তরায়ণ, কবি, কান্না, কালিন্দী, গণদেবতা, চাঁপাডাঙার বউ, জয়া, ডাকহরকরা, দুই পুরুষ, ধাত্রীদেবতা, না , ফরিয়াদ, বিচারক, বিপাশা, মঞ্জরী অপেরা, রাইকমল, শুকসারী, সন্দীপন পাঠশালা, সপ্তপদী, হার মানা হার, হাঁসুলীবাঁকের উপকথা  এবং বেদেনি প্রভৃতি।

উপন্যাস

নিশিপদ্ম, চৈতালি ঘূর্ণি, পাষাণপুরী, নীলকণ্ঠ, রাইকমল, প্রেম ও প্রয়োজন, আগুন, ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী,গণদেবতা,মন্বন্তর,পঞ্চগ্রাম,কবি, সন্দীপন পাঠশালা,ঝড় ও ঝরাপাতা,অভিযান,সন্দীপন পাঠশালা,পদচিহ্ন,উত্তরায়ণ,হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, তামস তপস্যা, নাগিনী কন্যার কাহিনী,আরোগ্য নিকেতন , চাঁপাডাঙার বৌ , পঞ্চপুত্তলি ,বিচারক,সপ্তপদী ,বিপাশা, রাধা, মানুষের মন , ডাকহরকরা ,  মহাশ্বেতা, যোগভ্রষ্ট, না, নাগরিক ,  নিশিপদ্ম, যতিভঙ্গ ,কান্না  ইত্যাদি।

ছোটোগল্প

ছলনাময়ী, জলসাঘর, রসকলি, তিন শূন্য, প্রতিধ্বনি, বেদেনী, দিল্লী কা লাড্ডু,যাদুকরী, স্থলপদ্ম, তেরশো পঞ্চাশ, প্রসাদমালা, হারানো সুর, ইমারত, রামধনু, শ্রীপঞ্চমী কামধেনু, মাটি, শিলাস্থান, বিস্ফোরণ, কালান্তর, বিষপাথর,  রবিবারের আসর, পৌষলক্ষ্মী, আলোকাভিসার চিরন্তনী, অ্যাক্সিডেন্ট, তমসা, আয়না, চিন্ময়ী, একটি প্রেমের গল্প, তপোভঙ্গ দীপার প্রেম, নারী রহস্যময়ী, পঞ্চকন্যা, শিবানীর অদৃষ্ট, গোবিন সিংয়ের ঘোড়া, জয়া, এক পশলা বৃষ্টি, মিছিল, উনিশশো একাত্তর।

নাটক

কালিন্দী, দুইপুরুষ, পথের ডাক, বিংশ শতাব্দী, দ্বীপান্তর, যুগবিপ্লব, কবি, কালরাত্রি, সংঘাত, আরোগ্য নিকেতন

প্রবন্ধ সংকলন

সাহিত্যের সত্য, ভারতবর্ষ ও চীন, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী।

স্মৃতিকথা

আমার কালের কথা, বিচিত্র স্মৃতিকাহিনী, আমার সাহিত্য জীবন, কৈশোর স্মৃতি, আমার সাহিত্য জীবন

রচনা-সংকলন

তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ গল্প, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় গল্প, স্বনির্বাচিত গল্প, গল্প-সঞ্চয়ন, ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প, রচনাসমগ- প্রথম খণ্ড, প্রেমের গল্প, ছোটদের ভালো ভালো গল্প, গল্প-পঞ্চাশৎ, কিশোর সঞ্চয়ন, ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প।

প্রহসন

চকমকি, ভ্রমণসাহিত্য, মস্কোতে কয়েক দিন

কাব্যগ্রন্থ    

ত্রিপত্র

পুরস্কার

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে “রবীন্দ্র পুরস্কার” লাভ করেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে “সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার” পান। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণে যান। এর পরের বছর তিনি অ্যাফ্রো-এশিয়ান লেখক সঙ্ঘের কমিটি গঠনের প্রস্ততিমূলক সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন গমণ করেন। এর পর তিনি তাসখন্দে অনুষ্ঠিত অ্যাফ্রো-এশিয়ান লেখক সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তারাশঙ্কর ভারত সরকারের পদ্মশ্রী ও ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।

 

Link copied!