মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের অধিকাংশের পরিচয় ঘটে একটি শক্ত-সুন্দর প্রবন্ধ দিয়ে। নাম ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’। যখন আমাদের সাথে তার পরিচয় ঘটে তখন আমরা সবে কৈশোরে পদার্পন করেছি। ফলে সেই শুরুটা আমাদের মনে দাগ কেটে যায় চিরদিনের মতো। সে কারণে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কাঠখোট্টা প্রাবন্ধিক পরিচয়টা আমাদের মনে গেঁথে যায়। ফলে তার যে কোমল একটি মনন রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানতেও পারি না।
নোয়াখালীর কাঞ্চনপুরে ১৯০৩ সালে জন্ম নেওয়া ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র অন্যতম পুরোধা এই ব্যক্তিত্ব কবিতা দিয়েই তার সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে কবিতার চেয়ে গদ্যই তাকে বেশি টানছিলো। তাইই হয়তো পুরো দস্তুর গদ্য লেখক বা প্রাবন্ধিক হয়ে উঠেছিলেন। অনেকেই বলে থাকেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী লেখার ধরনে প্রমথ চৌধুরী এবং মননে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই যার লেখালেখির সূত্রপাত কবিতা দিয়ে এবং যার মননে রবীন্দ্রনাথ বসবাস করেন তিনি কবিতা লিখবেন না এমনটা ভাবা আসলে ঠিক হয়।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী চতুর্দশপদী বা সনেটসহ বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। লিখেছেন গানও। তবে কবিতা বা গান দুটোর সংখ্যাই খুব কম। বা থাকলেও এখনো আমাদের চোখের সামনে আসেনি; গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়নি। সৈয়দ আবুল মকসুদ মোতাহের হোসেনের লেখা গান নিয়ে জানাচ্ছেন, ‘তাঁর গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল, বেতারেও প্রচারিত হতো গান। তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতা ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু তাঁর অধিকাংশ গানে সুরারোপ করতেন’ (ইকবাল, ভূঁইয়া, ২০১৮)।
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে মোতাহে হোসেনের ৩৮ টির মতো কবিতা-মৌলিক এবং অনুবাদসহ-মুদ্রিত হয়েছে। ১৯৪১ সালে নভেম্বর মাসে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মাধুরীলোকে’ নামে মোতাহের হোসেনের একটি চতুর্দশপদী কবিতা পাওয়া গিয়েছে। তার কয়েকটি লাইন নিচে তুলে দিচ্ছি:
মাধুরীলোকে
আমার চোখের আগে হাসিতেছে অনন্ত আকাশ,
সপ্তরঙা মেঘগুলি ‘দুলে, দুলে’ ডাকে ইশারায়,
প্রকৃতির গুপ্তপুরে কে যেন গো বাঁশরী বাজায়,
মনের গহনে মরি, কাঁপে তারি সুরের আভাস।
দুয়ারে বসিয়া একা, মৃদুমন্দ বহিছে বাতাস,
কেতকী গুণ্ঠন খুলি’ দিকে দিকে সুরভি বিলায়;
পুলক বেপথুভরা শেফালীরা মুখ তুলে চায়,
জীবনে উৎসব জাগে-বিধাতার পরম বিলাস।
আগেই বলা হয়েছে, তার লেখা কবিতা খুব একটা পাওয়া যায় না। কেননা, তিনি নিজে সেগুলো বই আকারে গ্রন্থিত করেননি। তবে যে নমুনা দেখানো হলো তাতে অনেকেই তার কবিতার কাব্যগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। এবং সেটাই স্বাভাবিক প্রশ্ন হবে। তবে কবিতার ব্যবচ্ছেদ কেবল একটি বা দুটি কবিতা দিয়ে হওয়া উচিত নয়। সবার আগে তার কবিতাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। তবে সাহিত্যমূল্য না হোক ঐতিহাসিক বিচারে তার কবিতার মূল্য অনেক। সুতরাং, ইতিহাসের কাঠগড়ায় তোলার জন্য হলেও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই দিকপালের কবিতাগুলোর একটি সংকলন থাকাটা জরুরী।
১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করে মোতাহের হোসেন চৌধুরী কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুলে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৪৬ এ কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে লেকচারার পদে যোগদান করেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করে সেখানে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা
বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির আন্দোলন হিসেবে পরিচিত ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের’ সাথে যুক্ত ছিলেন। এই আন্দোলনে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখের সহযোগী ছিলেন তিনি।মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখনীতে মুক্তবুদ্ধি, মননশীলতা, মানবতার ছাপ পাওয়া যায়। ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এবং এর মুখপত্র ‘শিখা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মোতাহের হোসেন।
তার মৌলিক রচনাগুলোতে নিজের জীবন দর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। মোতাহের হোসেন রবীন্দ্রনাথ ও বার্ট্রান্ড রাসেলের জীবনদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রবলভাবে। তবে তাঁর মৌলিক রচনাগুলোতে অন্যের প্রভাব খুব একটা পড়েনি। তিনি স্বকীয়তায় ভাস্বর। তার রচিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘সংস্কৃতি কথা’ (১৯৫৮)। এছাড়াও বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘কনকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থটি ‘সুখ’ নামে ভাবানুবাদ করেছেন। ক্লাইভ বেলের ‘সিভিলাইজেশন’-এর অনুসরণে লিখেছেন ‘সভ্যতা’। তিনটি গ্রন্থই তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পাদনায় তার প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা রচনাবলি আকারে প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনাকালে ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করে মোতাহের হোসেন চৌধুরী।