শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
      Beta

ইউক্রেন যুদ্ধের বোমা পড়ছে দরিদ্র দেশের অর্থনীতিতেও

The Report লুৎফর রহমান হিমেল
প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ০৩:২৫:০০ অপরাহ্ন | বিশ্ব

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল রাশিয়া। বছর ঘুরে এলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। বড় গাছের যেমন বড় ছায়া পড়ে, তেমনি বড় কোনো দেশ যুদ্ধে জড়ালে তার কালোছায়া পড়ে পুরো বিশ্বেই। ইউক্রেন যুদ্ধের কালো ছায়াও পড়েছে এখন বিশ্বে। এই এক বছরেই বিশ্ব রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে। বিশ্বের নানা দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা টানাপড়েন শুরু হয়েছে। অনেক দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিশ্বজুড়ে দেখা দিচ্ছে অর্থনৈতিক মহামন্দা। দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

যুদ্ধের বছর পূর্তির পর অনেকেরই প্রশ্ন, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? কে থামাতে পারবে এই যুদ্ধ? সাদা চোখে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে বলে মনে করা হলেও, এটি যে রাশিয়া আর পশ্চিমা ন্যাটো জোটের মধ্যকার লড়াই, তা সবাই জেনে গেছে। মূলত ইউক্রেন হচ্ছে এখানে প্রক্সি। যুদ্ধ থামানোর ভূমিকায় থাকার কথা ছিল ইউরোপের, কিন্তু তারা আর সে অবস্থানে নেই। ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্ররা চাচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেই সরিয়ে দিতে। ফলে, ইউক্রেন চাইলেও সমঝোতা আলোচনা সম্ভব হচ্ছে না। শান্তি আলোচনার তাবৎ উদ্যোগ তাই থমকে গেছে।

এরই মধ্যে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে। নতুন আরেকটি বছরে চলে গেল যুদ্ধটি। বিশ্বের সব বড় দেশের নেতারা যুদ্ধ বন্ধে বাস্তবধর্মী কোনো ফর্মুলা বাতলে দিচ্ছেন না। জাতিসংঘ কী করছে তা-ও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। একচোখা এই সংস্থাটির এ যুগে থাকা দরকার আছে কি না, তা নিয়েও অনেকে আবার কথা শুরু করেছেন। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি সামনের দিনগুলোতে বিশ্ববাসীকে আরও খারাপ সময়ের ভেতর ফেলে দেবে। পৃথিবী এর মধ্যেই মন্দা অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশ করেছে। এটা থেকে বের হওয়ার চাবিকাঠি শুধু আমেরিকার হাতেই। কারণ, ইউক্রেন কিংবা ন্যাটো দুপক্ষই আমেরিকার অধীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমেরিকা চাইলে যুদ্ধ বন্ধ করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আমেরিকা নানা কারণেই সেটি করবে না। এ কারণে এই যুদ্ধ দীর্ঘ একটা রূপ পেতে যাচ্ছে।

যুদ্ধের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক জেনারেল এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ মিক রায়ান বলছেন, স্বল্প মেয়াদে কোনো একটি পক্ষের কৌশলগত বিজয় কিংবা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরিভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা এখানে খুব কম। যুদ্ধরত কোনো পক্ষই এমন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি, যা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করতে পারে। ফলে যুদ্ধ সহসাই থামবে না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও বারবার বলে চলেছেন, তিনি পিছপা হবেন না। তিনি মনে করছেন কৌশলগত ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে তিনি এ যুদ্ধে লাভবান হবেন। কারণ দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং তারা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার পাশাপাশি চীনের হুমকির ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগী হবে। আত্মবিশ্বাসী রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেও কোনো ফল পায়নি পশ্চিমারা। ইউক্রেনের তরফেও সমঝোতার টেবিলে বসার মনোভাব নেই। ন্যাটো ও আমেরিকার প্রশ্রয়ে তারাও অনড় অবস্থানে।

এ অবস্থায় পুতিন ইউক্রেনে পরমাণু হামলা চালাবেন কি না সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে তিনি কিছু একটা যে করে ফেলবেন, তা নিশ্চিত। ইউক্রেনে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটুক আর নাই ঘটুক, এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতিতে তার চেয়েও বড় বোমা পড়ছে প্রতিনিয়ত।  বৈশ্বিক খাদ্যশস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষ এখন দিশেহারা। পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যয়সংকোচন নীতি নেওয়া হচ্ছে। আমদানি পণ্যেও আরোপ হয়েছে নানা বিধিনিষেধ। বাংলাদেশও ধুঁকছে খাদ্যপণ্য আমদানি নিয়ে। ফলে চলমান সংকট নিরসনে ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ বা ‘ব্যয় সংকোচন’নীতিকেই বেছে নিতে হয়েছে সরকারকে।

চলতি বছরটা বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। দেশের মানুষ ক্যালরির জন্য ভাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে আটা-ময়দার ওপরও ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এই আটা-ময়দা আসে গম থেকে যার বেশির ভাগই আমদানি করা হয় ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে। নানা গবেষণা থেকে দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। কিন্তু যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গমের দাম বেড়েছে অনেক। এতে বাংলাদেশে আটা-ময়দার দামও বেড়েছে। গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে নানা পদক্ষেপের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও বাধ্য হয়ে লোডশেডিংয়ের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। সরকারের এমন ‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনেও রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাসসহ দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। সেই সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থায়ও সমস্যা তৈরি হয়েছে, ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থাও। অনেক উন্নত দেশেও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জানিয়ে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়মুখী হওয়ার আহ্বানও রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী।

এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে এরই মধ্যে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ছে বারবার। এতে করে সামনে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে। ভোটের বছর এটি। এটি ইস্যু হিসেবে হাজির হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সামনের দিনগুলোতে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এমন প্রতিকূল পরিণতি বয়ে আনবে, যা বিশ্বের ভূ-অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন আকার দিতে পারে। বাংলাদেশকেও সেই প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট। ইমেইল: [email protected]