জুন ৩০, ২০২৫, ০২:২৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
নিজের ৯০তম জন্মদিনের আগে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের তিনদিনের বড় এক সমাবেশে দালাই লামা যে ভাষণ দিতে যাচ্ছেন তাতে এই তিব্বতি আধ্যাত্মিক নেতার কাছ থেকে তার উত্তরসূরি নির্ধারণের রূপরেখা শোনার অপেক্ষায় আছেন ভক্ত-অনুসারীরা।
এ সমাবেশে দালাই লামা কী বলতে যাচ্ছেন এবং তার উত্তরসূরি নির্ধারণের রূপরেখাই বা কেমন হবে, সেদিকে চীনও তীক্ষ্ণ নজর রাখছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
চীনের কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ বিদ্রোহের পর ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে পালিয়ে যান এখনকার দালাই লামা। বেইজিং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখে, তারা তার উত্তরসূরিও ঠিক করতে চায়।
এদিকে দালাই লামা বলছেন, তার উত্তরসূরি চীনের বাইরেই জন্মাবে। বেইজিং যদি কাউকে ঠিক করে দেয়, তাহলে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে অনুসারীদের প্রতি আহ্বানও আছে তার।
তিব্বতি বৌদ্ধদের বিশ্বাস, আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন সন্ন্যাসীরা তাদের জ্ঞানের উত্তরাধিকার বহন করে যেতে পুনর্জন্ম নেন।
আগামী রোববার ৯০ বছর বয়সে পড়তে যাওয়া এখনকার চতুর্দশ দালাই লামা বলেছেন, তিনি জ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তার মৃত্যুর পর তার সম্ভাব্য উত্তরসূরীকে কোথায় পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সম্ভাব্য ধারণা দিয়ে যাবেন। এই উত্তরসূরী ছেলেও হতে পারে, মেয়েও হতে পারে।
“বাকি জীবন আমি যতটা সম্ভব, যতটা বেশি করা যায় অন্যদের কল্যাণে ব্যয় করবো,” দালাই লামার দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রার্থনা করা অনুসারীদের এক সমাবেশে সোমবার এমনটাই বলেছেন তিনি।
তিব্বতি এ ধর্মগুরু আরও বলেছেন, “এক ধরনের রূপরেখা দেওয়া হবে, যার মাধ্যমে আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দালাই লামাদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা নিয়ে আলোচনা করতে পারবো।”
তিনি এর আগে বলেছিলেন, ভারতেই তিনি পুনর্জন্ম নিতে পারেন। হিমালয়ের উত্তরে ভারতীয় শহর ধর্মশালায় তার নির্বাসিত জীবন কাটছে।
তিনি মাত্রা দুই বছর বয়সে দালাই লামা নির্বাচিত হয়েছিলেন; পূর্বসূরী, ত্রয়োদশ দালাই লামা তার ভেতরেই পুনর্জন্ম নিয়েছেন বলে তিব্বতি বৌদ্ধদের বিশ্বাস।
ধর্মশালায় নির্বাসিত তিব্বতি পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার দোলমা সেরিং তেইখাং বলেছেন, উত্তরসূরী নিয়ে দালাই লামার কাছ থেকে সরাসরি শোনা বিশ্ববাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
“কারণ চীন প্রতিটি সুযোগে তাকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে, পাশাপাশি তারা দালাই লামার পুনর্জন্ম কিভাবে হবে সে বিষয়ক নিয়মকানুন নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা করছে।
“চীন চাইছে এই প্রতিষ্ঠানকে দখলে নিতে, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমরা চাই, দালাই লামার পুনর্জন্ম হোক কেবল তিব্বতকে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জাতি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্যই হোক,” বলেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে তিব্বতের প্রধান জ্যোতিষী থুপতেন এনগোদাপ বলেছেন, সাধারণত উত্তরসূরীর পুনর্জন্ম নিয়ে আলোচনা দালাই লামারা জীবিত থাকা অবস্থায় হয় না। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ব্যতিক্রম, চীন সরকারের হস্তক্ষেপ এর প্রধান কারণ।
চলতি বছরের মার্চে বেইজিং বলেছিল, রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাসিত এখনকার দালাই লামার ‘কোনো অধিকারই নেই তিব্বতি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার’।
দালাই লামা যদি তিব্বত ও তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন তাহলে বেইজিং তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে রাজি বলে প্রস্তাবও দিয়েছে। ধর্মশালায় নির্বাসিত সরকার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
‘যেন তিনি আর নেই’
দিনকয়েক পরে তিব্বতি বৌদ্ধদের যে ধর্মীয় সম্মেলন হতে যাচ্ছে, ২০১৯ সালের পর সেটি আর হয়নি। শতাধিক তিব্বতি বৌদ্ধ নেতার অংশ নেওয়া এ সম্মেলনে দালাই লামার একটি ভিডিও বক্তৃতা থাকবে।
যারা অংশ নেবেন তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন তিব্বতি বৌদ্ধদর্শন অনুসরণ করা হলিউড তারকা রিচার্ড গিয়ারও থাকবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
আগামী ৫ জুলাই, শনিবার নির্বাসিত তিব্বতি সরকারের এক প্রার্থনায় অংশ নেবেন দালাই লামা; পরদিন তার জন্মদিনের আয়োজনেও তিনি থাকবেন বলে আয়োজকদের দেওয়া অনুষ্ঠানসূচিতে দেখা যাচ্ছে।
জন্মদিনের উৎসবে তিনি প্রায় আধাঘণ্টা বক্তৃতা দেবেন। ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ও আরও কিছু ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তা এ উৎসবে অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
তিব্বতিরা তার দীর্ঘায়ুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। করে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তার হাঁটুর অপারেশন হওয়ার পর থেকে এ প্রার্থনার পরিমাণ বেড়েছে। অবশ্য ডিসেম্বরে রয়টার্সকে দালাই লামা বলেছিলেন, তিনি ১১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারেন।
আগের দালাই লামা মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
দালাই লামার মৃত্যুর পর তার গাদেন ফোদরাং ফাউন্ডেশন পরবর্তী দালাই লামাকে খুঁজে বের করবে; নতুন দালাই লামা দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত নির্বাসনে থাকা সরকারই সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।
এখনকার দালাই লামা-ই ২০১৫ সালে এ ফাউন্ডেশন বানান; এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও তিনিই বেছে নিয়েছেন। এ কর্মকর্তাদের মধ্যে তার কয়েকজন সহযোগীও আছে।
তেইখাং ও অন্যান্য তিব্বতি কর্মকর্তারা বলেছেন, দালাই লামা অনেকদিন ধরেই তার অনুপস্থিতিকালীন সময়ের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করছেন। ৩৬৮ বছরের রীতি ভেঙে ২০১১ সালে তিনি তার রাজনৈতিক দায়িত্ব একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দেন। এর আগ পর্যন্ত দালাই লামারা একইসঙ্গে তিব্বতিদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় নেতার দায়িত্বই পালন করতেন।
“তিনি যেহেতু মানুষের রূপে এসেছেন, তাই একসময় তিনি যে আমাদের মধ্যে থাকবেন না, এটা তো মানতেই হবে। হিজ হোলিনেস সেই দিনের জন্য আমাদের ভালোভাবেই প্রস্তুত করেছেন, তিনি এমনভাবে আমাদের কাজ শিখিয়েছেন, যেন তিনি আর নেই,” বলেছেন তেইখাং।