ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সচিত্র সংবাদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। ওই খবরটিতে এক শিশুর মানবিক কষ্টগাঁথা তুলে ধরা হয়েছে। খবরটির কেন্দ্র একটি শিশু, যাকে দৈনিকটি দিনমজুর হিসেবে তুলে ধরে। প্রথম আলোর ভাষ্য, ওই শিশুটি বলেছে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত খবরটি নিয়ে সরেজমিন সংবাদ করেছে একাত্তর টিভি। একাত্তর টিভির সংবাদে দেখা গেছে, খবরটির সত্যতা সঠিক নয়। ওই শিশুটিও দিনমজুর নয়। তার নামও জাকির নয়, সবুজ। যদিও সংবাদটি প্রকাশের পরপরই সরিয়ে নেয় প্রথম আলো।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, এরকম বাছবিচার ও সত্যতা যাচাই ছাড়াই সংবাদ প্রকাশ অপরাধ। প্রথম আলোর এমন সংবাদে পাঠক প্রতারিত হয়েছেন।
দৈনিকটির ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাইরাল হওয়া খবরের ওই ছবিটিতে দেখা যায়, ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে এক শিশু, নাম জাকির হোসেন (প্রকৃত নাম সবুজ)। শিশুটির উদ্ধৃতি ছিলো এরকম: ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ প্রকাশের সাথে সাথেই অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ে সংবাদটির স্ক্রিনশট। এরপরই প্রথম আলো সংবাদটি সরিয়ে নেয়।
দৈনিকটি প্রকাশিত খবর সরিয়ে নিলেও সেটির কপি ঘুরছে অনেকের টাইমলাইনে। অনেকে সেসব পোস্টের নিচে মন্তব্য করেছেন, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে প্রথম আলোর এমন খবর প্রচার ১৯৭৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে বাসন্তীর জাল পরানো ছবির কথা মনে করিয়ে দিলো।
এদিকে ঘটনার সত্যতা খুঁজতে একাত্তর টিভির প্রতিবেদক সরেজমিনে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথম আলোয় প্রকাশিত ছবিটি শিশুদেরকে দেখাতেই তারা ছবির শিশুটিকে চিনতে পারে। তারা জানায়, তার নাম সবুজ, জাকির নয়।
উপস্থিত শিশুরা আরও জানায়, সবুজ স্কুলে পড়ে। প্রতিদিন সে পড়াশেষে গোসল আর খাওয়া দাওয়া সেরে মায়ের সাথে স্মৃতিসৌধে ফুল বেচতে আসে।
স্থানীয় কুরগাঁও পাড়ায় বাবা-মার সাথে থাকে সবুজ। সবুজের মা মুন্নী বেগম গণমাধ্যমকে জানান, তিন সন্তানের মধ্যে মেজো সবুজ। তার সন্তানের নাম কীভাবে জাকির হোসেন হলো, আর তার প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া সন্তানকে কেন দিনমজুর বলা হলো, বুঝতে পারছেন না তিনি।
মুন্নী বেগম জানালেন, রাজমিস্ত্রী বাবা আর তার আয়ে এ বছরই লাগোয়া বাথরুমসহ ঘর ভাড়া নিয়েছেন। ভাতের জোগাড় হয়। আর ছোট সবুজ কীভাবে জানবে বাজারের খবর। সে তো ছোট।
সবুজকে দেখে বোঝাও যায়, বাজার, স্বাধীনতা আর চাল-ডালের রাজনীতি বোঝার মতো বয়স তার হয়নি। তার ছবি পত্রিকায় আসায় সে নিজেও অবাক হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া ওই ছবিটি সম্পর্কে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেছেন, ১৭ মিনিট পরেই নিউজটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
তবে এ ঘটনা সরকার ও দেশের জনগণের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচিার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে তিনি বলেন, এ ঘটনায় সরকারের হয়তো কিছু আসে যাবে না। সরকার আসবে যাবে-এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের ১৫ কোটি মানুষ এ ঘটনায় প্রতারিত হয়েছেন বলে আমি মনে করি।
ঢাবির এই সাবেক উপাচার্য আরও বলেন, ১৯৭৪ সালের ঘটনাটি যেভাবে টাকার বিনিময়ে বাসন্তিকে জাল পরিয়ে সাজানো হয়েছিল, এই শিশুটিকেও ১০ টাকা দিয়ে ছবি তোলা ও বলানো একই উদ্দেশ্যে বলে আমি মনে করি। বিষয়টি সত্য হলে কোনো সমস্যা ছিল না। ৬ বছরের শিশু সে স্বাধীনতা, বাজারের অবস্থা সম্পর্কে কীভাবে বুঝবে? শিশুটিকে টাকার বিনিময়ে বলানোর মতো অনৈতিক কাজ কোনো গণমাধ্যম বা সাংবাদিক করতে পারে না। প্রথম আলো এটা ভাল করেনি।
যদি চক্রান্তই না হবে তাহলে ১৭ মিনিট পর ছবিটি সরিয়ে ফেললো কেন? প্রশ্ন রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক উপাচার্য বলেন, মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে প্রথম আলো তার নৈতিকতা হারিয়েছে এবং গণমাধ্যমটির যে বিশাল পাঠক সমাজ রয়েছে, ওইসব পাঠকদের সাথেও প্রতারণা করেছে বলে আমি মনে করি।
খবরটিকে এত সহজ করে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম। তিনি বলেছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখানে যেন কোনো অজুহাত না হয়।