মার্চ ২৩, ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম
ছবি: দ্য রিপোর্ট লাইভ
ক্ষমতা ও রাজনীতির জটিল খেলায় একজন মন্ত্রী হতে কী প্রয়োজন? প্রতিভা নাকি তোষামোদ? সততা নাকি অঢেল অর্থ?
একজন তরুণ, ধনী, এবং রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী ব্যক্তি।
মন্ত্রীত্বের বাসনায় বিভোর সবসময়। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষমতার জন্য নিজের ভাইকে হত্যার মতো ঘটনা কি নেই তার অপরাধের ঝুলিতে?
অন্যদিকে, সচিব পদোন্নতির দৌড়ে রাজনীতির ছদ্মবেশী চরিত্র, নতজানু মনোবৃত্তি, এবং ক্ষমতার জন্য নৈতিক অধঃপতন – সবই যেন চোখের সামনের বাস্তবতা।
’প্রতিমন্ত্রী’ এবং ’ভারপ্রাপ্ত সচিব’ উপন্যাসে এসব প্রশ্নের উত্তরই খুঁজেছেন লেখক আন্দালিব রাশদী। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষমতার জন্য ভাই হত্যা, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা—এসবই উঠে এসেছে তার লেখায়।
দুই যুগ আগেই এসব কালো অধ্যায়কে উপন্যাসের পাতায় ধরে রেখেছিলেন তিনি।
আর আজ, সেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ রুখতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার চেয়ারে বসেছেন স্বয়ং লেখক!
আন্দালিব রাশদী নামে পরিচিত এই সাহিত্যিকের প্রকৃত নাম ড. মো. আব্দুল মোমেন।
তুমুল জনপ্রিয় দুটি উপন্যাস ’ভারপ্রাপ্ত সচিব’ এবং ‘প্রতিমন্ত্রী’ ছাড়াও বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে তিনি নাম কুড়িয়েছেন শতাধিক প্রবন্ধ, উপন্যাস, অনুবাদ ও গল্প লিখে।
বর্তমানে দুর্নীতিবাজদের সনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করার দায়িত্ব নেওয়া এই মানুষটির সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল মূলত আর্থিক প্রয়োজনে।
তবে একই সাথে অর্জন করেছিলেন পাঠকপ্রিয়তা।
বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখির মাধ্যমে তিনি জীবন চালাতেন এবং সাহিত্যিক স্বীকৃতি অর্জন করেন। অনেক সময় ভিন্ন নামে লেখালেখি করতেন যাতে করে নিজের আয় রোজগারের পথটি খোলা থাকে।
১৯৫৭ সালে ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকায় জন্ম আব্দুল মোমেনের। তার বাবা এ এফ এম আবদুল মোতালেব ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা।
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, নটরডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি।
এরপর আলাদাভাবে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ালস থেকে।
১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্য থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ড. মোমেন।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) ১৯৮২ ব্যাচের একজন সদস্য হিসেবে কর্মজীবন শুরু তার। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক, বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও।
তবে ২০০৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার যুগ্মসচিব থাকা অবস্থায় ড. মোমেনকে ওএসডি করে।
এবং পরে ২০১৩ সালের ৬ই জুন তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু বারবার বাধার সম্মুখীন হন।
কিন্তু হাল ছাড়েননি। অবশেষে নিজের সহজাত প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
আর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।
তার সহকর্মীদের ভাষায়, তার লেখা ছাপার ক্ষেত্রে এক ধরনের অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞার মতো নিরুৎসাহ থাকতো।
কিছু করার ছিল না। নানা কৌশলে ছাপতে হতো। তবে অপরিচিত নামগুলোর জন্য তিনি লিখে উপার্জন করার পথটা খোলা রাখতে পেরেছিলেন।
তার নিজের লেখায়:
“আমি সেধে কাউকে লেখা দিই না; কিছু বিনিময় মূল্য না পেলেও লিখি না। আমি মূলত গদ্যই লিখি, কিছু অনুবাদ করি, ১৯৭১ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বন্ধুদের অনেকেই সবমিলিয়ে যতটা না পাঠ করেছেন আমি তার চেয়ে বেশিই সম্ভবত লিখেছি।”
তার সহকর্মী ও পরিচিতজনদের মতে, আবদুল মোমেন একজন সৎ ও মেধাবী মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
তার এক সহকর্মীর দৃষ্টিতে, “মোমেন ভাইকে সম্ভবত ২টা প্যান্ট ২টা শার্টেই দেখেছি একযুগ ধরে। তাও খুব ম্লান।”
ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁর পরিবর্তে রাস্তার পাশের চায়ের দোকান বা সাধারণ খাবারের দোকানে খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
সরকারি চাকরির পর জীবনের কঠিন সময়েও তিনি হাসিখুশি থাকতেন এবং নিজের সততার পথ থেকে বিচ্যুত হননি।
৫ই আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তাকে সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।
পরে স্বরাষ্ট্রের দুই বিভাগের দায়িত্ব পান তিনি। পরে ডিসেম্বরে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বেশ কয়েকজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
নতুন দায়িত্বে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, যা তার সততা ও দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
আন্দালিব রাশদী ওরফে আবদুল মোমেন একজন বিরল প্রতিভার অধিকারী, যিনি একইসাথে সাহিত্য ও প্রশাসনিক জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তার জীবন সততা, সংগ্রাম ও নিষ্ঠার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
যদিও তাকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে, তিনি কখনো আপোষ করেননি।
তার সাহিত্যের মতোই, তার জীবনও একটি অনুপ্রেরণার গল্প।