সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনায় দেশব্যাপী পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর ৩১৩ স্থাপনায় হামলা ও অগ্নি সংযোগ হয়েছে। তাদের সাজোয়াঁ যানসহ বিভিন্ন গাড়িও ভাঙচুর করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলোকে তারা বলেছে, ১৫-২২ জুলাই- এই ৮ দিনের মধ্যে ঘটেছে এসব ঘটনা। এর মধ্যে পুলিশের ৩ ও আনসারের ১ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ বাহিনীর ১ হাজার ৩৮১ সদস্য।
বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ ও সংঘাত ঘিরে ৪ বাহিনীর প্রায় ৩০০ গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যান আর্মর্ড পারসোনেল ক্যারিয়ারেও (এপিসি)। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কার্যালয়ের পাশাপাশি থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা করায় গত ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এরপর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়াতে থাকে। ১৮-২০ জুলাই- এই ৩ দিনে সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, এই ৩ দিনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ছিল ৮৯টি। এর মধ্যে বেশির ভাগ লক্ষ্যবস্তুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি স্থাপনা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক (এআইজিপি) ইনামুল হক সাগর প্রথম আলোকে বলেন, “যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়, তখন সবার আগের পুলিশকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এবারও তাই হয়েছে। এ ক্ষেত্রে থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন কার্যালয় তাদের হামলার লক্ষ্য ছিল।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-সংঘাত চলাকালে দেশব্যাপী পুলিশের ২৩৫ স্থাপনায় অগ্নি সংযোগ ও ভাঙচুরের তথ্য প্রথম আলোকে দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র। এগুলোর মধ্যে আছে থানা, বিভিন্ন ইউনিটের কার্যালয়, ফাঁড়ি, ক্যাম্প ও পুলিশ বক্স। ২৩৬টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে পিকআপ, আর্মর্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), রেকার, জিপ, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি। পুলিশের ৩ সদস্য নিহত হন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৩১ জন। এর মধ্যে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন ৪ জন।
কোটা আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীতে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় ৬৯টি পুলিশ বক্সসহ ৮০টি স্থাপনা ও কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সংঘাতে ডিএমপির যে পরিমাণ স্থাপনা, যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ৬১ কোটি টাকা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীন পাঁচটি থানায় হামলার খবর পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা, গাজীপুরের গাছা থানা, টঙ্গী পশ্চিম থানা ও বাসন থানা এবং ঢাকার বাইরে নরসিংদীর হাইওয়ে থানা অন্যতম।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র্যাবের কোনও স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটেনি বলে বাহিনী দুটির পক্ষ থেকে জানা গেছে। তবে সংঘর্ষে বিজিবির ৫২ ও র্যাবের শতাধিক সদস্য আহতের খবরও চোখ এড়ায়নি। এ ছাড়া তাদের ১৩টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে এসেছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, “সহিংসতা সৃষ্টিতে বাধা মনে করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লক্ষ্য করে পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে।”
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় মতিঝিল থানায় সংযুক্ত একজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৯৮ জন। ৭৮টি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কেপিআইভুক্ত (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকা বাহিনীটির ৭৪টি গার্ডে (ক্যাম্প) হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার রয়েছে ৩০টি।
ওই বাহিনী জানায়, রাজধানীর মালিবাগে আবুল হোটেল এলাকার আনসারের গাড়ি রাখার ডিপোতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হাতিরঝিলে আনসারের ট্রাফিক ব্যারাক ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাহিনীটির শেরপুর ও রংপুরের জেলা কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে।
আনসারের সহকারী পরিচালক মো. রুবেল হোসাইন প্রথম আলোকে জানান, সংঘাত-সহিংসতায় তাঁদের তিনটি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ২৩টি গাড়ি ও মোটরসাইকেল। অগ্নি সংযোগ ও লুট হয়েছে ২০টি মোটরসাইকেল।
কোটা আন্দোলনে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এরপর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে এখনও কারফিউ জারি আছে।