নারীবান্ধব আইন প্রণয়ন বাস্তবায়ন করলেও সিডও সনদের বাস্তবায়ন হয়নি বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক সিডও দিবস পালন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা।
রবিবার বিকেলে আন্তর্জাতিক সিডও দিবস পালন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে ‘‘অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন: নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বাস্তবায়ন’’ বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সিডও সনদেও ধারা ২ এবং ধারা ১৬.১ (গ) এর উপর সংরক্ষণ বহাল রেখেছে। ধারা দুটির সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীর অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়। এই ধারা দুটির সংরক্ষণ নারীর অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রচলিত পারিবারিক আইন এদেশের সকল নারী পুরুষের কার্যকর সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্তর্জাতিক উপপরিষদ সম্পাদক দেবাহুতি চক্রবর্তী।
উক্ত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘ সিডও কমিটির প্রাক্তন সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওয়াই ডব্লিউ সিএ অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনীষা সরকার;মহিলা ঐক্য পরিষদ এর সহ-সভাপতি গীতা বিশ্বাস; বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন এর সহ-সভাপতি রাখী রং এবং ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার সেবিকা দেবনাথ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বলা হয়, সিডও সনদের দুটি ধারার উপর সংরক্ষণ বহাল থাকায়, নারীর অধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়নে এই সংরক্ষণ বিরাট এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নারীর অবস্থা ও অবস্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে লক্ষ্য করা যায় সংবিধানে নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় ইতিবাচক দিক এবং সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আইন সংস্কারসহ নানা উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরও ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতার ক্ষেত্র, নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্রমবর্ধমান সহিংসতা বৃদ্ধি এবং সহিংসতার ঘটনায় বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নারীর জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। পাশাপাশি নারীর ব্যক্তিজীবনে অধিকারের অসম ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে সমান সুযোগের অভাব। নারীর ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতার ক্ষেত্রগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পৃক্ত যা নারীর অবস্থানে প্রান্তিকতা সৃষ্টি করছে। সাম্প্রতিককালে বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে উঠেছে, এই ক্ষেত্রে বিরোধিতাও করছে। বিষয়টিকে সিডও সনদ বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে বৈষম্যপূর্ণ পারিবারিক আইন বাস্তবায়ন করা যায় সেবিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানানো হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতিসংঘ সিডও কমিটির প্রাক্তন সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ১৯৮১ সালের এই দিনে সিডও প্রথম যাত্রা শুরু করে। এই সুদীর্ঘ সময়ে সারা পৃথিবীতে নারীদের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৮১টি দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার নারীবান্ধব প্রচুর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলেও সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়নি। এতে সিডও সনদকে আইনে পরিণত করা যাচ্ছেনা, কোর্টে উত্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। সমতার আন্দোলন কার্যকর হচ্ছে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও অভিন্ন পারিবারিক প্রণয়ন অত্যাবশ্যক বলে উল্লেখ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, আইন প্রণয়নে রাজনীতির একটা বড় প্রভাব আছে। তিনি বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদে, ভরণপোষণে বিভিন্ন ধর্মীয় আইনের নিয়ম কানুনে উল্লেখ করে বলেন ল কমিশন এখনো চেষ্টা করছে অভিন্ন আইন প্রণয়নের। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যখন অভিন্ন পারিবারিক আইন নিয়ে কাজ শুরু করে তখন মনে হয়েছিলো সমাজ এটা আস্তে আস্তে গ্রহণ করবে , কিন্তু বাস্তবে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ অবস্থায় অভিন্ন পারিবারিক আইনের জন্য অ্যাডভোকেসী ক্রমাগতভাবে চলতেই থাকবে।
ওয়াই ডব্লিউ সিএ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হেলেন মনীষা সরকার বলেন, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন আজ সময়ের দাবি। সরকার প্রদত্ত আইন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করলেও ক্রিশ্চিয়ান নারীরা এখনো সমঅধিকার পাচ্ছেনা ক্রিশ্চিয়ান রীতি নীতি ও প্রথা অনুসারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পুরুষরা বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার পেলেও নারীদের জন্য বিষয়টি সহজ নয়; একজন পুরুষ সাক্ষী সহজে যোগাড় করতে পারলেও নারীর জন্য বিষয়টি সহজসাধ্য নয়।
মহিলা ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি গীতা বিশ্বাস বলেন, হিন্দু নারীরা তাদের বাবা বা স্বামীর কোনো সম্পত্তি পায়না। তাদের সম্পত্তিতে সমঅধিকার দেয়ার জন্য সরকারের সাথে জোরালোভাবে অ্যাডভোকেসি করতে হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়নের সহ-সভাপতি রাখী বলেন, যেখানে যেখানে নারী ও পুরুষের প্রতি বৈষম্য আছে তা দূর করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী, সাঁওতাল ও মালো নারীদের ভূমির উপর কোনো অধিকার নেই; বিবাহ বিচ্ছেদে নারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা নেই।
ভোরের কাগজের সিনিয়র সেবিকা দেবনাথ, সিডও সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কর্মসূচীতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ খুব জোরালো তা বলা যাবেনা। সিডও সনদ বাস্তবায়নে ধারাবাহিকভাবে নারী আন্দোলনকে ও নারী সংগঠনকে কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, পত্রিকায় গত দুইমাসে প্রকাশিত সহিংসতার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নারীর হত্যার সংখ্যা ধর্ষণের চেয়ে কম নয়। আমাদের সমাজে চলছে ক্ষমতা আকড়ে থাকার দর্শন। এবং ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাংঘর্ষিক সমাজ তৈরি হচ্ছে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না হওয়ায় পুরো সমাজ গণতন্ত্রহীন, বিচারব্যবস্থাহীন সমাজে পৌঁছে গেছে। দুইদশকের বেশি সময় ধরে অভিন্ন পারিবারিক আইনের জন্য আন্দোলন চলছে, জেন্ডার ইস্যু রাষ্ট্রীয় নীতির অনুষঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছে। এতে নারীর মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। সমাজে নারীবিদ্বেষের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, আইনের প্রয়োগ হচ্ছেনা , সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে, নারীর বিরুদ্ধে ধর্ম কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিন্ন পারিবারিক আইন বাস্তবায়ন করতে হলে নারী আন্দোলনকে আরো অগ্রসর হতে হবে; চিন্তা ভাবনা ও কাজে নারী সমাজকে দক্ষ হতে হবে; জেন্ডার গ্যাপ দূর করতে নারী বিষয়ে সরকারকে গবেষণা করতে হবে;তিনি আরো বলেন অভিন্ন পারিবারিক আইন বাস্তবায়িত হলে নারীর অবস্থা দৃঢ় হবে এজন্য সমাজের মধ্যে চলমান মতানৈক্য ও বিদ্বেষ দূর করতে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে আন্দোলন করতে হবে।
উক্ত সভায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির নেত্রীবৃন্দ, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ; বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, উইমেন ফর উইমেন,ঢাকা ওয়াইডব্লিউ সিএ, কর্মজীবি নারী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক, সংগঠনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্তর্জাতিক উপপরিষদ সদস্য লুনা নূর।