আগস্ট ১৬, ২০২৪, ০৩:২৮ পিএম
কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন তার স্ত্রী আয়েশা বেগম। ২০১৮ সালের ২৬ মে র্যাবের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একরামুল হক। স্ত্রী আয়েশা বেগমের ভাষ্য, “আজ পর্যন্ত ভয়ে বিচার চাইতে পারিনি। মামলাও করিনি। বিভিন্ন সময় নানাভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। দুজন মন্ত্রী ফোন করে আমাকে চুপ থাকতে বলেছিলেন। তাই চুপ হয়ে বসেছিলাম। এখন ভয় কেটে গেছে। এবার মামলা করবো।”
বুধবার (১৪ আগস্ট) বিকেলে টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীপাড়ায় একটি দোতলা বাড়ির জরাজীর্ণ কক্ষে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
একরামুল হক কখনোই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলেও উল্লেখ করেন স্ত্রী আয়েশা। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “আমার স্বামী মাদক ব্যবসার সঙ্গে কখনও জড়িত ছিলেন না। তবু মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কী অপরাধ ছিল তার? মানুষের জীবনের কোনও দাম নেই? কেন এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো? ৬ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল, কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। আজ পর্যন্ত ভয়ে বিচার চাইতে পারিনি। মামলাও করিনি। বিভিন্ন সময় নানাভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। দুজন মন্ত্রী ফোন করে আমাকে চুপ থাকতে বলেছিলেন। তাই চুপ হয়ে বসেছিলাম। তবে এই অবিচারের কথা ভুলিনি, কখনও ভুলবো না। হত্যার বিচার আমৃত্যু চেয়ে যাবো। এখন ভয় কেটে গেছে। এবার মামলা করবো।”
যে কক্ষে বসে আয়েশা বেগম সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন, সেই কক্ষের দেয়ালে মার্কার কলমে লেখা আছে, ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে?’, ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে?’, ‘আব্বু তুমি বাড়িতে কবে আসবা’, ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনও বিচার পাবো না?’- এমন নানা কথা। স্কুলপড়ুয়া তাহিয়াত হক ও নাহিয়ান হক তাদের বাবা একরামুল হক হত্যার বিচার চেয়ে দেয়ালে নানা প্রশ্ন লিখেছে। যা আজও নানা প্রশ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখেছে আমাদের।
স্বামী একরামুল হকের মৃত্যুর ৬ বছর ২ মাস ১৯ দিন হয়েছে উল্লেখ করে আয়েশা বেগম বলেন, “এখনও বিচারের অপেক্ষায় আছি। তখন হুমকি ও ভয়ের কারণে মামলা করতে পারিনি। এখন আমার ভয় কেটে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ায় বিচারের আশায় বুক বেঁধেছি। এই সরকারের সহায়তায় আমি এবার স্বামী হত্যার মামলা করতে চাই। যাতে স্বামী হত্যার বিচার পাই।”
একরামুল হকের স্ত্রী বলেন, “এর আগে অনেকে বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। স্বামী হত্যার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা, মামলা করতে চাওয়ায় আমাদের পরিবারকে অনেক হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিচার চাওয়ার কথা বললে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে এই বিষয়ে গণমাধ্যমে যেন কোনও কথা না বলি, সেটা বলে দিয়েছিলেন। আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, চুপ থাকেন। আমরা আপনার দাবির বিষয়টা দেখছি। কিন্তু পরে আর কিছুই হয়নি।”
বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি আরও বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচিত। শেখ হাসিনার নজরে এলেও কোনও পদক্ষেপ নেননি।”
এ সময় একরামুল হকের স্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, এই হত্যার দায় কি (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা এড়াতে পারেন? তিনি অভিযোগ করেন, “শেখ হাসিনার নজরে এলেও কোনও পদক্ষেপ নেননি। এই হত্যার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। কারণ আমার স্বামী উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ছিলেন। দলের একজন কর্মীকে এভাবে হত্যার পরও কোনও ব্যবস্থা নেননি তিনি। এমনকি মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি আমি। এতটি বছর কেটে গেলো। কেউ খোঁজ নেয় না, কীভাবে আমি আমার সংসার চালাচ্ছি। আমার দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি।”
একরামুল হত্যাকাণ্ডে র্যাব জড়িত ছিল উল্লেখ করে আয়েশা বেগম বলেন, “হত্যাকাণ্ডে র্যাব জড়িত। তখন র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা যারা ছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনা গেলে এই হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশের পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক হলে হত্যা মামলা করবো। বর্তমানে দুই মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। বৃষ্টি হলে এই ঘরে পানি পড়ে। ঘুমানো কষ্টকর। তবু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমাদের।”
স্বামী একরামুল হকের কথা মনে করে অশ্রুসজল নয়নে স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, “হত্যার পর ঘটনাস্থলে পাওয়া আমার স্বামীর চশমাটি একজন বৃদ্ধ লোক এসে একদিন বাসায় দিয়ে গেছেন। সেই চশমায় এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। এর চেয়ে বেদনার কী হতে পারে। প্রতিদিন স্বামীসহ আমরা ৪ জন একসঙ্গে খেতে বসতাম। কিন্তু এখন খাওয়ার সময় তার কথা খুব মনে পড়ে খুব। তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করলে তাকে মনে পড়ে। এমনকি মেয়েরা তাদের বাবার পছন্দের কোনও খাবার রান্না করলে কান্না করে, কষ্ট পায়। কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমরা।”
এখন দুই মেয়ে বড় হয়েছে, তারাও বাবা হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করতে চায় উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আয়েশা বেগম বলেন, “যারা মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করেছিল তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। যাতে আর কোনও নিরীহ মানুষ এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, যেহেতু সবকিছু নতুন করে শুরু হয়েছে, সেহেতু এই হত্যার তদন্ত হোক। মামলার ব্যাপারে এই সরকারের সর্বোচ্চ সহযোগিতা চাই আমি। আশা করছি, এই সরকারের কাছে আমি স্বামী হত্যার বিচার পাবো।”
২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। ওই বছরের ২৬ মে রাতে টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একরাম। তার বাবার রেখে যাওয়া ৪০ বছরের পুরনো বাড়ির একটি কক্ষে থাকতেন। ব্যাংকে টাকাপয়সা নেই, ধারদেনা করে পৈতৃক ভিটায় বাড়ি তোলার কাজ শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে সেদিন সন্ধ্যায় যখন বেরোন, তখন মোটরসাইকেলে তেল ভরার মতোও টাকা ছিল না তার কাছে। বাসার উল্টো দিকের একটি হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে বেরিয়েছিলেন।
একরামের স্বজনরা জানান, হত্যার দুই দিন আগে টেকনাফে গুজব ছড়িয়েছিল, একরামুল ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অনবরত একরামুলকে বিরক্ত করছিলেন। বারবার বলছিলেন, একরামুল যেন তাদের একখণ্ড জমি কেনায় সহযোগিতা করেন। তাদের চাপাচাপিতেই একরামুল বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হন। জমির বিষয়টা ছিল অজুহাত।