যতদিন দরকার শেখ হাসিনাকে রাখবে ভারত: ভারতের পররাষ্ট্র সচিব

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ৭, ২০২৫, ০১:০৩ পিএম

যতদিন দরকার শেখ হাসিনাকে রাখবে ভারত: ভারতের পররাষ্ট্র সচিব

ছবি: সংগৃহীত

ভারত সফররত বাংলাদেশের কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতির (ডিক্যাব) একদল প্রতিনিধির সাথে মতবিনিময় করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।

সোমবার (৬ অক্টোবর) মতবিনিময়ের সময় তিনি মন্তব্য করেন, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার যে অনুরোধ করেছে সেটি একটি আইনগত বা বিচারিক বিষয়। ভারত এটি বিবেচনা করছে এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ওই সময় বিক্রম মিশ্রি আরও জানান, বাংলাদেশের জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে রাজনৈতিক সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত ভারত। যদিও যে ভারত বারবার বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক (ইনক্লুসিভ ও পার্টিসিপেটরি) নির্বাচনের কথা বলছে, সেখানে আওয়ামী লীগ-বিহীন নির্বাচনকে তারা কতটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবে, সে প্রসঙ্গ বিক্রম মিশ্রি এড়িয়ে গিয়েছেন।

প্রশ্ন হলো, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কেন বললেন শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ ভারত যথাযথ নিয়ম অনুসারে বিবেচনা করে দেখবে?

এই প্রশ্নের জবাবে দিল্লিতে সাউথ ব্লকের একটি সূত্র বলেছেন, ‘খেয়াল করুন কথাটা উনি কোন প্ল্যাটফর্মে ও কাদের কাছে বলেছেন। বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথি সাংবাদিকদের সামনে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ও একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাবে তিনি ও কথা বলেছেন ... কারণ ওখানে এটা বলা সম্ভব নয় যে না, আমরা ওনাকে কিছুতেই ফেরত দেব না। বরং এই পরিস্থিতিতে ‘ডিপ্লোম্যাটিক্যালি কারেক্ট’ ভাষা ও ভঙ্গিতে যেটুকু বলা যায় সেটাই তিনি বলেছেন।’

তাই বলা যায়, শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের কোনও সম্ভাবনা নেই এটা যেমন ঠিক – তেমনি তাকে আবার ভারত নিজে থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে ‘পুনর্বাসন’ করিয়ে দেবে, এমন কোনও ভাবনাও দিল্লির নেই।

এটার একটা বড় কারণ হলো- বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট এমনিতেই যথেষ্ট চড়া। আর ভারত সেটা বুঝতেও পারছে। সেটাতে আরও উসকানি দেওয়াটা ভারতেরই স্বার্থবিরোধী হবে।

বিক্রম মিশ্রির কথা থেকে অনেকেই উপসংহার টানছেন – ভারত বোধহয় অবশেষে এই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে খুব শিগ্‌গিরই আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ঘটছে না এবং আগামী নির্বাচনেও তাদের অংশগ্রহণের কোনও সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি অনেকে এমনটাও মনে করছেন যে শেখ হাসিনাকে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় হস্তান্তরের সম্ভাবনাও ভারত এখন হয়তো পুরোপুরি নাকচ করছে না।

এর মাত্র কয়েক দিন আগে নিউ ইয়র্ক সফরকালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিও-র মেহদি হাসানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘তারা বোধহয় এখনও আশা করছেন যে উনি (শেখ হাসিনা) পূর্ণ গৌরবের সাথে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতার বেশে ফিরবেন!’

শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের সরকার-প্রধান এবং ভারতের সর্বোচ্চ কূটনীতিবিদের এই দুটো আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক আছে কোনও সন্দেহ নেই!

শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত আসলে যা করতে চাইছে এবং বাংলাদেশ বিষয়টিকে যেভাবে দেখছে তার মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য আছে। কিন্তু দিল্লিতে শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে চিন্তাভাবনাটা আসলে কী?

বাংলা ট্রিবিউন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দিল্লিতে একাধিক শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক কূটনীতিবিদ ও থিংকট্যাংক ফেলো-র সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের মোটামুটি সর্বসম্মত রায় হলো: শেখ হাসিনা ভারতকে একটা ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু’ সিচুয়েশনে ফেলেছেন – তাকে এখন দিল্লি না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে!

কিন্তু তার মানে কখনোই এই নয় যে ভারত তাকে সংকটের মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।

পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘ভারত কিন্তু তাকে নিজে থেকে এ দেশে আশ্রয় দেয়নি, পরিস্থিতির চাপে একরকম বাধ্য হয়েছে বলা যেতে পারে। তিনি এ দেশে আসার পরও বেশ কিছুদিন চেষ্টা হয়েছে তাকে সম্মানের সঙ্গে তৃতীয় কোনও দেশে পাঠানো যায় কি না, শেষ পর্যন্ত সব শর্ত না মেলায় সে চেষ্টাতেও আপাতত হাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, আর সেটা কখনও ভাবাও হয়নি।’

কেন এই ‘অপশন’টা বিবেচনা করা হচ্ছে না, তার কিছু নির্দিষ্ট ও জোরালো কারণও আছে।

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ টিসিএ রাঘবন বলছেন, ‘আজ যদি ভারত তাদের এত বছরের পরীক্ষিত বন্ধু শেখ হাসিনার পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশে কখনেও কোনেও নেতাই ভারতের বন্ধুত্বে আস্থা রাখতে পারবে না। ফলে আমরা চাই বা না-চাই, শেখ হাসিনাকে আমরা কিছুতেই ফেলতে পারব না!’

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী বিক্রমজিত ব্যানার্জি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গত অগাস্টের পালাবদলের পর যেভাবে ঢালাও মিথ্যা মামলার ধূম পড়েছে এবং আদালত প্রাঙ্গণেও সাবেক নেতা-মন্ত্রীদের হেনস্তা হতে হচ্ছে তাতে ভারত এটা মনে করতেই পারে যে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করা হলেও তিনি আদৌ সুষ্ঠু বিচার পাবেন না। শুধু এই যুক্তিতেই প্রত্যর্পণের অনুরোধ খারিজ করা সম্ভব।’  

বিজেপির ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্তর কথায়, ‘ভারত তার আতিথেয়তা, নিরাপত্তা বা সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে, অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তার এদেশে থাকার ব্যবস্থা করেছে – কিন্তু বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কোনও দায়িত্ব নেয়নি।’

‘আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি কখনও শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের অনুকূল হয় এবং তিনি নিজে মনে করেন দেশে ফিরে যাবেন তাহলে অন্য কথা – কিন্তু সেটা না হলে ভারত তাকে ‘প্যারাড্রপ’ করে বাংলাদেশে বসিয়ে দিয়ে আসবে বলে ভাবছে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।’

ফলে ‘শেখ হাসিনা বীরের বেশে বাংলাদেশে ফিরবেন বলে ভারত এখনও ভাবছে’ বলে সম্প্রতি ড: ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন সেটাকেই খন্ডন করছেন ভারতের পর্যবেক্ষকরা। তারা অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সেই বক্তব্যও ছিল ‘নিছকই রাজনৈতিক’!

এত কিছুর পরেও যে প্রশ্নটা থেকেই যায় তা হলো- ভারতে শেখ হাসিনার তাহলে ভবিষ্যৎ কী?

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ওনাকে এখন বেশ লম্বা সময় এখানেই থেকে যেতে হবে। চট করে অন্য কোথাও যাওয়ার তো কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘বিদেশি নেতা-নেত্রীদের আশ্রয় দেওয়ার ঐতিহ্য আছে ভারতের। তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা আজ ছেষট্টি বছরের ওপর ধরে ভারতে আছেন। সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লাহ’র পরিবারও এদেশে আছেন তিরিশ বছরের ওপর। আমি নিশ্চিত শেখ হাসিনাকেও ভারত যতদিন দরকার হবে রাখবে এবং তার প্রাপ্য সম্মান দিয়েই রাখবে।’

ফলে শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার যেমন কোনও বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা নেই – তেমনি ভারত নিজে হাতে করে তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করবে এমন কোনও লক্ষণও কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। দৃশ্যমান ভবিষ্যতের জন্য তাকে আপাতত ভারতের অতিথি হয়ে সে দেশেই থাকতে হবে, এটাই বাস্তবতা।

Link copied!