জন্ম থেকেই মায়ের বুলি শোনেনি জাহিদ হাসান (সুমন)। তাই বলার ক্ষেত্রেও ইশারাই যেন তার মাতৃভাষা। বলতে এবং শুনতে না পারায় বাকি ৮-১০ জন শিক্ষার্থীর মতো তার ঠাঁই হয়নি সাধারণ স্কুলে। তাই বধির স্কুলেই হয়েছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি।
স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, হাত নাড়িয়ে ইশারায় কথা বলছেন সবাই। ইশারার ভাষা এখনও পুরোপুরি অনেকে আয়ত্ত করতে পারেনি অনেকে। যার ফলে একে অপরকেও সহায়তা করছেন।
সুমনের মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী আছে এই স্কুলে। সুমন এবং তার বন্ধুরা সবাই এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। জাহিদ হাসান (সুমন) ইশারায় কথা বলতে, পড়তে কিংবা বুঝতে, কি ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয় সে বিষয়ে জানতে চাইলে ইশারায় বুঝিয়ে দেন তার মনের অভিব্যক্তি। আর সাথে সাথেই সেটি বলে দিচ্ছেন দোভাষী ফিরোজা বেগম।
সুমন জানান, আমরা বধির যেই ভাই-বোনেরা আছি সবাই খুব মিশুক এবং বধির সংস্থার সবকিছুই ভালো। স্কুলটাও ভালো কিন্তু আমাদের ইশারার ভাষাটা বোঝাতে কষ্ট হয় এটার আরও উন্নতি প্রয়োজন এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে কিছু শব্দ কি হবে সেগুলোর ভাষা বোঝাটাই কষ্টসাধ্য। তাই ইশারা ভাষায় দক্ষ এমন কাউকেই প্রত্যাশা করেন তাদের পাশে।
সুমনের সহপাঠী মো. তুষার আবদুল্লাহ জানায়, আমরা সবাই এসএসসি পরিক্ষার্থী আমাদের প্রশ্ন উত্তর সমাধানে অনেকটাই কষ্ট হয়, শিক্ষকরা অনেকটাই সদয় আচরণ করে আমাদের প্রতি। তবে অনেকেই আমাদের ভাষা বোঝে না আর পরিবারের একটা কষ্ট রয়েই যায়। তারাও আমাদের ইশারার ভাষা বোঝে না।
বিশাল সাহা বলেন, বন্ধুদের সাথে অনেক ভালো সময় কাটাই খুব ভালো লাগে কিন্তু ওরা ছাড়া বাইরের কেউ আমার ভাষা বোঝে না। মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট হয় আমি কেন সবার মতো কথা বলতে পারি না।
শুধু সুমন নয় বরং বধির স্কুলের শিক্ষার মাধ্যমে দেশ বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছেন অনেকে। কথা হলো বধির স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী মো. সিরাজ উদ্দিন রাফির সাথে। বাংলাদেশ থেকে তিনি প্রথম শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী হিসেবে পাড়ি দিয়েছেন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রাশিয়ায়। অংশগ্রহণ করেছেন র্যাম্প শোতে, পেয়েছেন সম্মাননা।
নিজের সন্তানের মতো পরম মমতায় বধির এই শিক্ষার্থীদের দেখভাল করেন ইশারায় দোভাষী ফিরোজা রানী। তিনি বলেন, আমি বধির সংস্থার ইশারা ভাষায় দোভাষী। আমি ২০১৬ সাল থেকে এখানে কর্মরত আছি। আমার বাবা-মা দুজনেই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী সেখান থেকে আমার অভিজ্ঞতা। ইশারায় কথা বলা এক প্রকার প্রয়োজন থেকেই পেশা হিসেবে নেয়া।
প্রয়োজনের তুলনায় দোভাষী অল্প উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে খুব অল্প দোভাষী রয়েছে। কিন্তু শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী সংখ্যা অনেক। এদের জন্য পাশে দাঁড়ানোর মানুষ খুবই কম। আমি চেষ্টা করি সব সময় এদের পাশে থাকতে। নয়টা পাঁচটা ডিউটি থাকলেও, সেক্ষেত্রে ছয়টা সাতটা বেজে যায় শুধু ওদের জন্যই আমার থাকতে হয়। যখনই যা সমস্যা হয় দেখা যাচ্ছে যে আমাকে ফোন করছে, রাত দুটো বাজে আমাকে ফোন করেছে ভিডিও কলে কথা বলে ওদের সমস্যার সমাধান করি। কারণ আমার বাবা মা ভুক্তভোগী তাই ওদের প্রতি একটা ভালোবাসা আমার বরাবরই আছে। ইশারাটি ওদের মায়ের ভাষা আর ইশারা দিয়ে ওদের সাথে কথা বলা হয়।
১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করে বধির হাইস্কুলটি তখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৭ থেকে ৮ জন। তবে শুধু নৈশ বিদ্যালয় থাকলেও পরবর্তীতে প্রাথমিক পর্যায়ে এবং বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার সুবিধা আনা হয়েছে। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এখান থেকে।
ঢাকা সরকারি বধির উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এটি প্রতিবন্ধীদের জন্য সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরপরে শিক্ষা লাভ থেকে তারা বঞ্চিত হয় এবং অভিভাবকগণ জানে না তাদের জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা আছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন তারা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না বিশেষভাবে শিক্ষার জন্য। তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন অভিভাবকদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন এবং সমগ্র দেশে এটি প্রচার প্রসারের দরকার।
তিনি আরও বলেন, আমার দেখা মতে প্রতিবন্ধীদের লুকিয়ে রাখা হতো পরিবারে। প্রকাশ করা হতো না কারণ তারা মনে করত প্রতিবন্ধী মানেই অভিশাপ, প্রতিবন্ধী মানেই সমস্যা। আমি বলব তারাও এ দেশের নাগরিক। এই ভাষার মাসে আমি দাবি করব তাদের উপযোগী একটি কারিকুলাম তৈরি করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সহজ করা ও তাদের নির্দিষ্ট ভাষাটাকে স্বীকৃতি দেয়া।
নতুন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও বধিরদের দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে কার্জক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার সভাপতি শাহাদাৎ আলম হারু চৌধুরী বলেন, ১৯২০ সনে আমি এখানে পদার্পণ করি। বিগত ৫৭ বছরে। পুতির সংস্থার কতটুকু উন্নতি হয়েছে তা বধির ভাইয়েরা ভালো জানেন। তৎকালীন সময় আমরা এসে পেয়েছিলাম ২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। আজকে সেই সংস্থায় আমরা ফিক্সট ডিপোজিট করেছি ৮ কোটি টাকা। এছাড়াও বধির ভাইদের বয়স্ক ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, আর্থিক সহযোগিতা এবং বিভিন্নভাবে শুধু বধির প্রতিবন্ধী নয় তাদের সাথে যারা অন্ধপ্রতিবন্ধী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাদেরও আমরা সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। বধির দিন নিয়ে আমাদের কর্মপরিকল্পনা ব্যাপক বিগত সময়েও ছিল কিন্তু আমি এসে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্প পাইনি।
প্রত্যেক শিশু বিশেষ গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিবন্ধীরাও তার ব্যতিক্রম নয়, যথাযথভাবে পরিচর্যা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেলে তারাও পরিণত হবে দেশের সম্পদে জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতিতে রাখতে পারবে অবদান।