ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘ আগামী মাস থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য বরাদ্দ ১২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলার করতে যাচ্ছে। এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে বলেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে খাদ্যের বিশাল ঘাটতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনার প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “গতকাল আমাকে মৌখিকভাবে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছিল। আর আজ আমাকে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে জানানো হয় যে, বরাদ্দকৃত ১২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে মাসিক বরাদ্দ ৬ ডলার করা হবে। আর এটি কার্যকর হবে ১ এপ্রিল থেকে।”
মুঠোফোনে এই কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, “খাদ্যের জন্য তারা এখনই যে পরিমাণ বরাদ্দ পায় তা পর্যাপ্ত নয়। এখন নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে তা যদি আরও কমিয়ে আনা হয় তার পরিণতি কল্পনা করাও কঠিন।”
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির- ডাব্লিউএফপি, ঢাকার একজন মুখপাত্রকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রিত আছেন। যারা মূলত ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে প্রতিবেশী মিয়ানমারে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন। তারা বর্তমানে কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরে বসবাস করছেন। যেখানে তাদের কর্মসংস্থান বা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৭০,০০০ রোহিঙ্গা গত বছর বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, যার একটি বড় কারণ ছিল তাদের জন্মভূমি রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকট।
রয়টার্সের হাতে থাকা এক চিঠিতে ডাব্লিউএফপি জানিয়েছে, তারা মাসিক খাদ্য বরাদ্দ ১২ দশমিক ৫০ ডলারে ধরে রাখতে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছিল, কিন্তু দাতাদের খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
ডাব্লিউএফপি সতর্ক করে বলেছে, খাদ্য বরাদ্দ ৬ ডলারের নিচে নামিয়ে আনলে তা “জীবিকা নির্বাহের ন্যুনতম স্তরেরও নিচে চলে যাবে এবং মৌলিক পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হবে।”
ডাব্লিউএফপি আরও স্বীকার করেছে যে, “শরণার্থীদের সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়” এবং এই বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া তাদের জীবনধারায় তীব্র সংকট সৃষ্টি করবে ও শিবিরগুলোর মধ্যে “উদ্বেগ ও উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে।” তারা বলেছে, বহু দাতার কাছে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে, তবে ব্যয় সংকোচন করেও সংকট সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এই বরাদ্দ হ্রাস যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের বৈশ্বিক পররাষ্ট্র সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তের কারণে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানায়নি ডাব্লিউএফপি। মিজানুর রহমান বলেন, এটি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল কমানোর ফলাফল, কারণ দেশটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার সবচেয়ে বড় দাতা।
তবে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
ত্রাণখাতে সংকট
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের আকস্মিকভাবে বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ করা এবং মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাকে-ইএসএআইডি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
এর ফলে সুদান ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে লক্ষাধিক মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য মার্কিন অর্থায়িত জীবনরক্ষাকারী কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও অবশ্য বলেছেন, ওয়াশিংটন তার বৈদেশিক সহায়তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করেনি, বরং জরুরি সেবাগুলোর জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি শুক্রবার কক্সবাজার সফরের সময় সামাজিক মাধ্যম এক্স-এর এক পোস্টে বলেন, যদি দাতাদের সহায়তা “নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়, যা হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ সরকার, ত্রাণ সংস্থাগুলো এবং শরণার্থীদের দ্বারা সম্পাদিত বিশাল পরিমাণ কাজ বাধাগ্রস্ত হবে, যা হাজার হাজার মানুষের জন্য ক্ষুধা, রোগ ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলবে।”
জাতিসংঘের তথ্যে উঠে এসেছে, এর আগেও ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য বরাদ্দ মাসিক ৮ ডলারে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এর ফলে তীব্র খাদ্য সংকট ও অপুষ্টি বৃদ্ধি পায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই শিবিরের ৯০ শতাংশ মানুষ “পর্যাপ্ত খাদ্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল” এবং ১৫ শতাংশের বেশি শিশু অপুষ্টির শিকার হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
পরে এই কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছিল।
এখন মাসিক বরাদ্দ ৬ ডলারে নামিয়ে আনার অর্থ হল শরণার্থীরা প্রতিদিন মাত্র বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪ টাকা বরাদ্দ পাবে।
কক্সবাজারের সরকারি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বাস্তবতা হল “একটি কলার দাম প্রায় ১০-১২ টাকা, আর একটি ডিমের দাম ১২-১৪ টাকা।”
ইউএসএআইডি জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য জরুরি খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদান করে আসছে, যার মধ্যে নগদ অর্থ, খাদ্য ভাউচার এবং ত্রাণ সহায়তা অন্তর্ভুক্ত।
মিজানুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালে রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে, যা মোট সহায়তার ৫০ শতাংশের বেশি।
তবে ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক সহায়তা সংকোচনের ফলে হাসপাতাল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি মার্কিন অর্থায়িত হাসপাতালকে তাদের সেবা কমাতে হয়েছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি খাদ্য বরাদ্দও কমিয়ে দেওয়া হয়, তবে এটি “মারাত্মক সমস্যা” তৈরি করবে।
“এই মানুষগুলো রাষ্ট্রহীন, ভাগ্যবিড়ম্বিত, এবং শুধুমাত্র তহবিল সংকটের কারণে তাদের এভাবে কষ্ট করা উচিত নয়,” বলেও মন্তব্য করেন মিজানুর রহমান।