বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র চেয়ারপার্সন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া | ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র চেয়ারপার্সন এবং দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ও অবিস্মরণীয় নাম বেগম খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী তিনি। এছাড়া মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকার প্রধানও বেগম খালেদা জিয়া।
একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের প্রশ্নে তিনি ‘আপসহীন’ নেত্রীর উপাধি পান।
গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রাম, আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন। খালেদা জিয়া শুধু একজন ব্যক্তি নন, নিজ কর্মগুণে নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। হয়ে উঠেছেন এক জীবন্ত ইতিহাস।
জন্ম :
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশব ও শিক্ষা জীবন:
খালেদা জিয়ার জন্মের পর প্রথম দুইবছর কাটে জলপাইগুড়িতে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ হলে তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার দিনাজপুরে চলে আসেন। সেখান স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
খালেদা জিয়ার শৈশব ও শিক্ষা জীবন কাটে দিনাজপুরে। পাঁচ বছর বয়সে খালেদা খানম পুতুলকে তার বাবা দিনাজপুরের সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে ভর্তি করান। সেখানে খালেদা জিয়া প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি দিনাজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে এ কলেজ থেকে খালেদা জিয়া ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
প্রাথমিক জীবন:
বেগম খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ফেনী জেলার বর্তমান পরশুরাম উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসার উন্নতি লাভের আশায় ইস্কান্দার মজুমদার দিনাজপুরে এসেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির পর তিনি দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
গ্রেড এইটের ছাত্র ইস্কান্দার মজুমদার ১৯১৯ সালে তার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে জলপাইগুড়িতে থাকতে গিয়েছিলেন। বর্তমানে জলপাইগুড়ি ভারতের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং একটি চা বাগানে চাকরি নেন। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে চায়ের ব্যবসা শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি জলপাইগুড়ির ‘চা বাগান সমিতি’র সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেখানে ১৯৩৭ সালের ১৯ মার্চ তার সঙ্গে তৈয়বার বিয়ে হয়। তৈয়বা বর্তমান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ীর বাসিন্দা।
এই পরিবার ‘টি-ফ্যামিলি’ নামে পরিচিত। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে, যাদের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। তার মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন সমাজকর্মী। তিনি তাঁর দিনাজপুরের বাড়িতে দুস্থ মহিলাদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করতেন। খালেদা জিয়ার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।
বিবাহ :
দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় পিত্রালয়ে ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদা খানম পুতুলের বিয়ে হয়।
দাম্পত্য জীবন :
জিয়া ও খালেদা প্রথম চার বছরের দাম্পত্য জীবন দিনাজপুরে কাটিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া বিয়ের পর জিয়াউর রহমানের গ্রামের বাড়ি বগুড়ার বাগবাড়িতেও থেকেছেন। বিয়ের পর তিনি স্বামীর কর্মক্ষেত্রের কারণে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেন।
জিয়াউর রহমানের পোস্টিং পাকিস্তান হওয়ায় ১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া স্বামীর সাথে সেখানে বসবাস করেন। তাঁদের দুই পুত্র। বড়ো সন্তান তারেক রহমান, তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ছোট সন্তান আরাফাত রহমান কোকো, যার জন্ম ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট, যিনি ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন রাজনীতিতে বেগম জিয়ার উপস্থিতি ছিল না। মূলত দুই পুত্রকে লালন পালন ও ঘরের কাজ করেই সময় কাটাতেন বেগম জিয়া।
মুক্তিযুদ্ধকাল :
মেজর জিয়া ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁকে জয়দেবপুর সাব ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই বছরই চারমাসের প্রশিক্ষণে তাঁকে পশ্চিম জার্মানি পাঠানো হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে মেজর জিয়াকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। জিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগ্রাসী দমননীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। প্রথম বারের মতো স্থানীয় রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে নিজের পরিবারকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে জিয়াকে এগিয়ে যেতে হয়। তখন অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল খালেদা জিয়ার জীবনে। যুদ্ধের প্রায় প্রথম দুই মাস খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে আত্মগোপনে ছিলেন সন্তানদের নিয়ে। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় আত্মগোপনে থাকা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। তখন তিনি চট্টগ্রামের বাইরে কোথাও সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার বড়বোন খুরশিদ জাহান হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেগম খালেদা জিয়া ৭১’ এর ১৬ মে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান। বোরকা পরিহিত অবস্থায় দুই সন্তানকে নিয়ে সেদিন নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান বেগম খালেদা জিয়া। একপর্যায়ে ঢাকায় আসেন তিনি।
ঢাকায় স্বজন ও পরিচিতজনদের বাসায় আত্মগোপনে থাকেন। এ অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২ জুলাই সিদ্ধেশ্বরীর একটি বাসা থেকে খালেদা জিয়াকে আটক করা হয়। গ্রেফতার করে দুই ছেলেসহ তাঁকে পুরনো সংসদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি সামরিক আইন প্রশাসনের কর্মক্ষেত্রও ছিল। পরে তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরের একটি বাসায় স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা হানাদারমুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া সেনা হেফাজতে ছিলেন। বন্দি অবস্থায় তিনি সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি সামলে চলেন। সংকটময় মুহূর্তে তিনি সবসময় নিজেকে ধীরস্থির রেখেছিলেন এবং ভেঙে না পড়ে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চৌকস সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী হয়েও বেগম খালেদা জিয়া সাধারণ বাঙালি গৃহবধূর মতো পরিমিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
জিয়ার মৃত্যু :
স্বামী জিয়াউর রহমানের জন্য খালেদা জিয়া অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন। বাসায় জিয়া না এলে ঘুমাতে যেতেন না। এ সময় তার সঙ্গী থাকতো বই ও পত্র-পত্রিকা। জিয়া এলে একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যেতেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাত দশটায় জিয়া চট্টগ্রাম থেকে বাসায় খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন কাল আসবেন। চট্টগ্রামে ভালো আছেন। কিন্তু সেটাই ছিল খালেদা জিয়ার কাছে জিয়ার জীবনের শেষ ফোন। চক্রান্তকারীরা জিয়াকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ একুশ বছরের তাদের মধুর দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৮১ সালের ১ জুন সকালে খালেদা জিয়া জানতে পারলেন স্বামী জিয়াউর রহমানের নির্মম বর্বরোচিত হত্যার খবর। স্বামী জিয়াউর রহমানকে হত্যায় খালেদা জিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। লাখো লাখো মানুষের মাতম আর আহাজারিতে শহীদ জিয়াকে সমাহিত করা হয় সংসদ ভবনের উত্তর পাশে ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে। জিয়ার জানাজা ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জানাজা। জিয়ার প্রতি মানুষের যে অকৃত্রিম ভালোবাসা সেটি দেশবাসী সেদিন দেখিয়েছিলো।
১৯৮১ সালের ৩ জুন স্বামীর কবরে এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়ার আগমনে সেদিন মাজার প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হয়েছিল এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের। ১৯৮১ সালের জুন মাসের শেষের দিকে টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারে বেগম খালেদা জিয়া বর্ণনা করেছিলেন স্বামীর অনাড়ম্বর সরল সংসারের ছবি।
রাজনৈতিক জীবন শুরু:
১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, বেগম খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোন অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেতো না।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ফরমান জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। বিচারপতি সাত্তারকে অপসারণ করেন।
একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে বিএনপির অনেক নেতার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান - এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা।
এরশাদ বিএনপির অভ্যন্তরে ভাঙন ধরানোর জন্য একের পর এক প্রচেষ্টা চালান। তখন অনেকটা আকস্মিকভাবেই রাজনীতিতে এলেন বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে আসার তার কোন পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয় বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসায়। বিএনপির নেতাদের পরামর্শ ও অনুরোধে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালে বিএনপিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ১৯৮৩ সালে ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।
আন্দোলন ও নেতৃত্ব :
দলে দায়িত্ব নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে গঠিত সাতদলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত এবং এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কয়েকবার আটক করে তৎকালীন স্বৈরাচার সরকার। সে সময়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এরশাদ সরকারের হাতে বেশ কশেকজন শহীদ হন। আন্দোলন দিনে দিনে বেগবান হতে শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ৩২১টির মধ্যে ২৭০টি ছাত্র সংসদে বিজয় লাভ করে, যা গণআন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের পতনে তাঁর নেতৃত্ব ছিল অবিস্মরণীয়। দীর্ঘ আন্দোলনে গণতন্ত্র প্রশ্নে লড়াই সংগ্রামে বেগম খালেদা জিয়া ‘আপসহীন’ নেত্রীর খ্যাতি লাভ করেন। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার জোরালো অবস্থান ছিল অতুলনীয়।
বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম নির্বাচন:
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বেগম খালেদা জিয়া। সে নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী :
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকার প্রধান হন বেগম খালেদা জিয়া। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব খালেদা জিয়া শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, বরং মুসলিম বিশ্বেও একজন পথিকৃৎ নারী সরকারপ্রধান হিসেবে বিরল মর্যাদা অর্জন করেন।
১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করে। তিনি ২ এপ্রিল সংসদে সরকারের পক্ষে এই বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে স্বপদে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেন। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাশ হয়।
প্রথম মেয়াদে (১৯৯১-৯৫) উল্লেখযোগ্য সাফল্য:
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পা রাখে। তাঁর প্রথম মেয়াদেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রসার, নারীর কর্মসংস্থানে অগ্রগতি এবং অর্থনীতির ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। তৈরি পোশাক খাতে পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং প্রায় দুই লাখ নারী নতুনভাবে যুক্ত হন।
তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানিবণ্টন ইস্যু উত্থাপন করেন, যার ফলে বাংলাদেশের ন্যায্য অংশ পাওয়া নিশ্চিত করার উদ্যোগ জোরদার হয়। ১৯৯২ সালে হোয়াইট হাউস সফরে তিনি রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে।
দ্বিতীয়বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ:
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। স্বল্প সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। কারণ পঞ্চম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নানা ইস্যুকে সামনে এনে টানা ১৭৩ দিন হরতাল করে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যগণ পদত্যাগ করেন। সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে প্রয়োজনীয় সদস্য না থাকায় বেগম খালেদা জিয়া ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেন। ষষ্ঠ সংসদে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিল পাস হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা রেখে যান বেগম খালেদা জিয়া।
তৃতীয়বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ:
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাস হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও এককভাবে ১১৬টি আসন পেয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। সে নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঁচটি আসন থেকে বিজয়ী হন।
চারদলীয় জোটগঠন:
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক ও অপশাসন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জোটভিত্তিক আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এই জোট।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন :
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বে চারদলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন বেগম খালেদা জিয়া। সে নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫টি আসনে নির্বাচন করে নির্বাচিত হন তিনি।
২০০১-২০০৫ মেয়াদে উল্লেখযোগ্য সাফল্য:
নারী শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সংস্কারে তাঁর সরকার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে। ২০০৫ সালে নারীর ক্ষমতায়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিশ্বের ক্ষমতাশালী নারীদের তালিকায় তিনি ২৯তম স্থান পান। তাঁর সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, উপবৃত্তি ও খাদ্য সহায়তা, সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধিসহ নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পরীক্ষায় নকল দমনেও তাঁর সরকারের সফলতা প্রশংসিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আলোচিত এক-এগারো:
সংবিধান অনুযায়ী ২০০৬ সালের নভেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন বেগম খালেদা জিয়া। ওই সরকার ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছিল। সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করে। একপর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তফসিল স্থগিত করা হয়।
গ্রেফতার ও রাজনৈতিক সংকট:
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় আসে ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের নানা কর্মকাণ্ড বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দুরে রাখার তৎপরতা তখন দৃশ্যমান হয়েছিল। এক-এগারোর সরকার বড় আঘাত হানে বিএনপির ওপর। বিএনপিকে ভাঙতে চেষ্টা চালায়।
বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াকে দিয়ে দলে ভাঙন ধরানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করে দলের প্রবীণ নেতা খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বেগম খালেদা জিয়ার জেষ্ঠ্যপুত্র ও বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান গ্রেফতার হন।
বেগম খালেদা জিয়াকে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেয়া হয়। তারেক রহমানকে মুক্তি দেয়া হয় ৩ সেপ্টেম্বর। গ্রেফতারের পর যৌথবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। কারামুক্তির পর তারেক রহমানকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন ও আরাফাত রহমান কোকোকে থাইল্যান্ড পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় থাকতেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
এক-এগারোর জেল জীবন:
বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার একটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে তাঁকে আটক রাখা হয়। এ সময়ে তার দুই সন্তানও কারাবরণ করেন। জিয়া পরিবারের ওপর এক এগারোর জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্যাতন নিপীড়ন ছিল বর্ণনাতীত।
পাশাপাশি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও সাবেক মন্ত্রী, আমলাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিএনপিকে বিভক্ত করতে নানামুখী তৎপরতা চালায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখনও কারাবন্দী খালেদা জিয়াই ছিলেন দলীয় ঐক্যের প্রতীক।
এক এগারো পরবর্তী সংকট:
২০০৭ সালের এক-এগারো ছিল একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। দেশকে রাজনীতিশূন্য এবং জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের নেতৃত্বে নতুন ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন:
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। নানা সংকট ও ষড়যন্ত্রের মাঝেই ওই নির্বাচনে অংশ নেয় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। এ নির্বাচনে বিএনপি বিরোধী দল হয়। বেগম খালেদা জিয়া ৩টি আসনে নির্বাচন করে সবকটিতে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। নির্বাচনটি ছিলো একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, যেখানে ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত ছিল নেপথ্য কুশীলবদের। তবুও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নেন বেগম খালেদা জিয়া। এ সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বেগম তিনি।
আওয়ামী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার:
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের দুই মাস না যেতেই রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর এক কাপড়ে বেগম খালেদা জিয়াকে শহীদ জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ৪০ বছরের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। যে বাড়িতে জন্ম তার দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর। এখানে তাদের শৈশব, কৈশোর ও বিবাহসহ বাচ্চাদেরও জন্ম হয়েছে।
সেদিন সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়া গুলশানে তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে আমাকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছে।’ তাঁর দীর্ঘদিনের সংসারের সব মালামাল ফেলে রেখে তাঁকে এক কাপড়ে সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। সেদিন খালেদা জিয়ার কান্নায় কেঁদেছিল সারাদেশের অগণিত মানুষ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ও রাজনৈতিক সংকট :
২০১১ সালের ৩০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রকাশের আগেই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এর বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট আন্দোলন করে। এক পর্যায়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলও এসে সরকার ও রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচন নিয়ে সংকট নিরসনে আলোচনা করেছিল। ওই অবস্থায় বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট মনোনীত ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ভোটারবিহীন ওই নির্বাচন ছিলো দেশের রাজনীতিতে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আটকে রাখা, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেন আসতে না পারেন সেজন্য বালির ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মতো কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছিল। বিএনপি ও বিরোধী দলের কয়েক লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের মতো ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকো, তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানসহ জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে হাসিনা সরকার।
মামলা ও সাজা :
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত করে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তাঁকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। পরবর্তীকালে দুদকের আপিলে এ মামলায় উচ্চ আদালত সাজা বাড়িয়ে রায় দেয়। জিয়া চ্যারিট্যাবল ট্রাস্ট মামলায়ও তাঁকে দণ্ডিত করে সাজা দেয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ফরমায়েশি রায়, হাসিনা সরকার তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে নানা উদ্যোগ নিলেও বেগম জিয়া দৃঢ় ছিলেন। বিচার বিভাগের প্রতি বিরূপ না হয়ে বরং আস্থা রেখেছেন। ফলে এসব মামলায় তিনি আপিলে খালাস পেয়েছেন।
কারাবন্দীকালীন অসুস্থতা :
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দী হওয়ার পর তিনি নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেগম খালেদা জিয়া কিডনি, লিভার জনিত, ডায়াবেটিস, আর্থাইটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। কারা হেফাজতে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা ভাইরাস মহামারী সংক্রমণের মুখে তাঁকে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি দেয়া হয়। বিএনপিসহ অনেকের অভিযোগ খালেদা জিয়াকে পরিকল্পিতভাবে অসুস্থতার মুখে ঠেলে দেয়া হয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন :
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অংশ নিয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ভোটগ্রহণের আগের রাতেই বাক্সে ব্যালট ভরে রেখেছিল আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা। এ নির্বাচনও ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এ নির্বাচনে বিএনপি জোটের অধিকাংশ প্রার্থীই নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে পারেননি। নির্বাচনে ছয়টি আসনে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয়ী দেখানো হয়। অনেক প্রার্থী শারীরিকভাবে নাজেহাল ও গ্রেফতার হয়েছিলেন। অসংখ্য নেতা-কর্মী মিথ্যা ও গায়েবী মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।
আন্দোলন ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন :
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। এরই মধ্যে সকল বিরোধী দলকে বাইরে রেখে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেন। নির্বাচনটি আমি- ডামির নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আওয়ামী লীগ মনোনীত ও আওয়ামী দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীরাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এরূপ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে সমর্থন ছিল। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দী করা হয়।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও খালেদা জিয়ার মুক্তি :
কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে উচ্চ আদালতের এক রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানায় দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৪ এর ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।
আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ওইদিন আরও কয়েকজন হত্যার শিকার হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশের ছাত্রসমাজসহ বিএনপি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শুরু থেকেই বিএনপি সমর্থন জানায়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে অংশ নেয়। এ আন্দোলন দমন ও নির্মূল করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গণহত্যাসহ নানা নির্যাতন নিপীড়ন চালায়।
আন্দোলন রূপ নেয় প্রবল গণঅভ্যুত্থানে। একপর্যায়ে চব্বিশের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। তার সাথে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানাও। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়।
শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিতর্কিত অনেক কর্মকর্তা ৫ আগস্ট-এর আগে ও পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে দেশেও অনেকে গ্রেফতার হন।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ এ শাসনকালে কখনো মাথানত করেননি বেগম খালেদা জিয়া। তিনি গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ছিলেন অবিচল ও আপসহীন।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেগম খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষ অবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান।